আগস্টের অভিশাপ
A Fictional Novel by
Biplab Pal © Biplab Pal : biplabpal2000@gmail.com
এটি একটি কাল্পনিক কাহিনি। রাজনৈতিক ক্রীড়া,
ষড়যন্ত্র, ক্ষমতার নিষ্ঠুরতা—যদিও এখানে উল্লেখিত কিছু চরিত্র ও ঐতিহাসিক ঘটনার ছায়াপাত
বাস্তবের স্মৃতি বহন করে, তবু এই উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র ও ঘটনা আসলে কল্পনারই সৃষ্টি।
তবুও, কখনও কখনও কল্পনাই সত্যের চেয়ে বেশি বাস্তব হয়ে ওঠে।
যখন দেশভাগের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার শুরু
করলাম, তখন এক নির্মম সত্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল আমার কাছে—দেশ কখনও সাধারণ মানুষের চাওয়ায়
ভাগ হয় না, ভাগ করে কিছু উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ক্ষমতালোভী রাজনীতিক। সেই ক্ষমতার খেলার অন্ধকারে
মানুষের জীবনের মূল্যে সেজেছিল রাজনীতির পাশা। কোটি কোটি সাধারণ মানুষ এক নিমিষেই পরিণত
হয়েছিল শরণার্থী, উদ্বাস্তু, ছিন্নমূল জীবনে।
আমি মূলত প্রবন্ধের লেখক। কিন্তু প্রবন্ধের
মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের অন্তরের সেই গভীর, অন্তর্লীন অন্ধকারকে ফুটিয়ে তোলা অসম্ভব।
তাদের আছে অর্থ, আছে ক্ষমতা—তাদের ইশারায় মিডিয়া নাচে, আর সাধারণ মানুষ নাচে মিডিয়ার
ইশারায়। এ যেন এক অদ্ভুত মায়ার জাল, যার বাইরে বেরোনো কঠিন, প্রায় অসম্ভব।
এই উপন্যাস তাই আমার এক ক্ষুদ্র প্রয়াস—সাধারণ
মানুষকে বোঝানোর জন্য, রাজনৈতিক ক্ষমতার লোভ কীভাবে ধর্মের নামে এই উপমহাদেশকে তিলে
তিলে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানুষ বুঝতে পারে না, অজান্তেই তারা হয়ে উঠছে এক আত্মঘাতী
নাটকের পুতুল।
অবশ্যই, উপন্যাসের নিজস্ব দাবি থাকে—থাকে
দর্শন, থাকে লেখনীর গভীরতা, থাকে এক অনিবার্য গল্পের আকর্ষণ। নইলে কেনই-বা পাঠক এই
কালো অন্ধকারের দিকে তাকাবে?
আমাদের বাঙালি জাতি আজ ধ্বংসের কিনারায়
দাঁড়িয়ে। ধর্মীয় রাজনীতির বিষাক্ত বাতাসে বেঁচে থাকার পথ ক্রমেই রুদ্ধ। আমি জানি,
মহাকালের সামনে ধ্বংসের স্রোত থামানো সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও আমার এই ছোট্ট প্রয়াস,
ক্ষমতার মুখোশ খুলে দেওয়ার এক ক্ষুদ্র সংগ্রাম মাত্র।
Biplab Pal.
2nd May,
Maryland USA 2025
প্রথম অধ্যায়- আগস্ট অভিশাপ - বিপ্লবের জীর্ণ ধ্বংসাবশেষ
ঢাকার ধূসর বিকেল । ২০২৫
অগাস্ট মাস। স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝখানে ক্যানভাসে
আটকে। ৫ই আগস্টের বিপ্লবের পর এক বছর অতিক্রান্ত। তবু বাতাসে এখনো ভেসে বেড়ায় আগুনের
ছাই, ছিন্নভিন্ন ব্যানার, রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা ইটের টুকরো আর গাড়ির ভাঙা কাঁচ। কারফিউ
উঠেছে বহু আগেই, তবু মানুষের মুখে স্বস্তি ফেরেনি। একটি শহর, যেন নিশ্বাস আটকে থাকা
বিশাল কোনো প্রাণী—কারা যে শাসক আর কে যে শোষিত, কেউ আর বুঝতে পারে না।
বিকালের
সূর্য লজ্জায় আবছা। পাখিদের কিচিরমিচিরও আজ
সতর্ক, বিবর্ণ। পথে পথে তরুণদের পোস্টার, "ইউনূস আমাদের ত্রাতা", "নতুন
দিনের প্রতিশ্রুতি"—অদ্ভুত আকুতি মেশানো
স্লোগান। কিন্তু শহরের অন্য কোণে, বিএনপির গোপন ছায়ায় লেখা: "নতুন নির্বাচন
চাই," "ইউনূস অবৈধ ক্ষমতার অধিকারী।" আওয়ামী লীগের স্মৃতি ধোঁয়ার
মত মিলিয়ে গেছে। তাদের নাম এখন অতীতের ক্ষণিক
ফিসফিস। কেউ বলে, "৭৫-এর অভিশাপ। তারা শেষ।"
রাস্তার
বাতি হঠাৎ জ্বলে ওঠে দিনের বেলাতেই, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি জানান দিচ্ছে নিজের উপস্থিতি।
কেউ একজন দেখেছে, শহরের কেন্দ্রীয় মোড়ে হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়েছিল এক বৃদ্ধ, মুখে
সাদা দাড়ি, হাতে একটি পুরনো পাণ্ডুলিপি। বৃদ্ধটি চিৎকার করেছিল, “ইতিহাস ফিরে আসে
বারবার, সাবধান!" এবং তারপরই বাতাসের সাথে মিলিয়ে যায়। যেন সে ছিল কেবলই দৃষ্টিবিভ্রম।
ঢাকা
ক্যান্টনমেন্টের পুরনো ভবনটি রহস্যের জাল বিছানো, দেয়ালের ফাটলে সাপের মতো ঘুরে বেড়ানো
অন্ধকার। এই রহস্যের মধ্যেই বসে তিনজন সামরিক কর্মকর্তা—কর্নেল ফারুক, কর্নেল রেজাউল
এবং মেজর আসাদ। তাদের সামনে পুরোনো টেবিলের ওপর মানচিত্র, পত্রিকার কাটা অংশ, আর হলদে
কাগজে লেখা প্রাচীন দলিল।
কর্নেল
ফারুকের চোখে ঝিলিক দেয় অতীতের আলো। তিনি ফিসফিস করে বলেন, "১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট।
আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে গভীর রাত। আমার বাবা ছিলেন সেই রাতের সাক্ষী। সেদিন তিনি তরুণ
ক্যাপ্টেন। অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে সেদিন পাল্টে গিয়েছিল বাংলাদেশের ভাগ্য। আজ আবার
সেই রাত ফিরে এসেছে, আরেকটি সুযোগ। ইতিহাস তো শুধু একটি বৃত্ত, বারবার একই পথে ফিরে
আসে।"
হঠাৎ
জানালার বাইরে থেকে ভেসে আসে পেঁচার বিষণ্ণ
ডাক। মেজর আসাদ চমকে ওঠেন, হাতের কাগজটা পড়ে যায় মাটিতে। কর্নেল রেজাউলের চোখে ভয়
এবং বিস্ময় । শাণিত দৃষ্টি। কেউ কিছু বলে না—কেবল বুঝতে পারে, ইতিহাসের ছায়াগুলো
দেয়ালে নড়েচড়ে উঠেছে, তাদের কথা শুনছে। দেয়ালের ফাটল দিয়ে যেন প্রবেশ করেছে সেই
রাতের অতীত, যে অতীত কখনো আসলে অতীত হয় না।
কর্নেল
ফারুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলেন, "এখন সময়, আবারও ইতিহাস লেখার। কিন্তু সাবধান,
এবার ইতিহাস যেন আমাদের হাতেই লেখে! নাহলে আমাদেরই কপালে লিখে দেবে অন্য কারো শাস্তি।"
কক্ষের
ভেতর হঠাৎ করে একটি বাতাসের ঝাপটা এসে সমস্ত কাগজপত্র উড়িয়ে দেয়। তারা স্তম্ভিত
হয়ে দেখেন—একটি মানচিত্র হাওয়ায় ভাসছে, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাদেরকে জানিয়ে দিচ্ছে,
এই দেশের ভাগ্য এখনো লেখা শেষ হয়নি।
কাজলের
মতো গাঢ় চোখে কর্নেল রেজাউল তার কথায় রহস্যের আভা মিশিয়ে যোগ করলেন, “তখনকার অফিসারদের
চোখে ছিল স্বপ্নের অদ্ভুত মায়া—সিনিয়র নেতৃত্বকে
সরিয়ে শক্তিশালী সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করা। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডকে কেউ কেউ ‘বিপ্লবের
জয়’ হিসেবে দেখেছিল, কিন্তু বাস্তবতার রহস্যময় হাত ছিল আরও জটিল। নানা গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব,
ষড়যন্ত্রের নকশা—শেষমেশ ভারতীয় প্রভাবের গোপন ছায়া আর আমেরিকার অদৃশ্য হস্তক্ষেপ।
ফারুক ভাই, তুমি কি মনে করো আমরা আবার সেই রহস্যের মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি?”
কর্নেল
ফারুক একটু থেমে গেলেন। তাঁর চোখে ঝলসে উঠল দৃঢ়তার আগুন, “হ্যাঁ, অবশ্যই। আজকের বাংলাদেশ
এক ভাঙা আয়নার মতো, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিভ্রান্ত মুখের প্রতিবিম্ব। ইউনূস সরকারের
ভিত্তি আসলে এক মরীচিকা। বিএনপি ভাবছে নির্বাচনে বড় জয় আসবে, তরুণরা চায় মুক্তি—একদিকে
ইসলামিক মূল্যবোধ, অন্যদিকে উদার অর্থনীতি। আর জামাত-শিবিরের ছায়া শক্তি? ওরা তো আসলে
নেপথ্যের খেলোয়াড়, ক্ষমতার বিভ্রান্ত চক্রে আবদ্ধ। এই গোলকধাঁধার মধ্যে সামরিক বাহিনী
ছাড়া পথ কোথায়?”
মেজর
আসাদের চোখে আগুনের মৃদু আভা, তরুণের মুখে জাতীয়তাবাদী ক্রোধ আর কৌতূহলের রহস্যময়
মিশেল। তিনি আস্তে করে বললেন, “স্যার, একাডেমিতে আমি শুনেছি ১৫ আগস্টের ‘বিপ্লব’-এর
নানা গল্প। কেউ বলে ওটা বীভৎসতা, কেউ বলে ঐতিহাসিক বিজয়। কিন্তু বাস্তব তো এই, বারবার
আমাদের বাহিনী শক্তি হারিয়েছে, বারবার ফিরে এসেছে ভারতের অদৃশ্য ছায়া। আওয়ামী লীগ
হারিয়ে গেছে, বিএনপি আর ইউনূস—কারো হাতে আসলে এই দেশ স্থিতিশীল নয়।”
কর্নেল
ফারুকের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল, “১৯৭৫ ছিল ইতিহাসের অর্ধেক জয়। আমরা এবার পুরোটা
চাই। গণতন্ত্রের মিথ্যা ভান দিয়ে এ দেশের সমস্যার সমাধান হবে না। ভারত সর্বদা বাংলাদেশের
পেছনে আছে, তাদের গোপন উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে দুর্বল করে রাখা। আজ শত্রু
কে আর মিত্র কে, সেটাও একটা রহস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।"
কর্নেল
রেজাউল টেবিলের ওপর পুরোনো এক ফাইল খুললেন—ভেতরে কিছু হলদেটে পত্রিকার কাটিং, বঙ্গবন্ধুর
বাসভবনের সামনে রক্তাক্ত অতীতের দৃশ্য। কর্নেল ফারুকের দিকে তাকিয়ে তিনি মৃদুস্বরে
বললেন, “তোমার বাবা সেই সময়ের নায়ক, কিন্তু শেষে তাকেও পালিয়ে যেতে হয়েছিল। ইতিহাসের
এই রহস্য, এই অদ্ভুত নিয়তি কি কখনো শেষ হয়, ফারুক?”
কথা
শেষ হওয়ার আগেই বাতাসে ফাইলের পৃষ্ঠাগুলো হঠাৎ উড়ে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো রহস্য তাদের
কাছে এসে ফিসফিস করে বলছে—ইতিহাস আজও শেষ হয়নি, কেবলই শুরু হয়েছে নতুন এক অধ্যায়।
ফারুক
হালকা স্বরে উত্তর দিলেন, “সেই রাতের রহস্য এখনো আমার চোখে লেগে আছে। আমার বাবা সরাসরি
দায়িত্বে ছিলেন না, কিন্তু তিনি ব্যারাকে ছিলেন। ভোরের আলো ফোটার আগেই খবর এসেছিল—‘শেখ
মুজিব সপরিবারে নিহত।’ অদ্ভুত এক আবেগময় রাত—কেউ আনন্দে মিষ্টি বিতরণ করছিল, কেউ গোপনে
কাঁদছিল। এই বাহিনীর মধ্যেই তো লুকিয়ে আছে স্বপ্ন আর বিভ্রান্তি—কারো কাছে বঙ্গবন্ধু
জাতির পিতা, কারো কাছে একনায়কতন্ত্রের মূর্তি।"
মেজর
আসাদ হাত মুঠো করে দৃঢ়তার সাথে বললেন, “স্যার, সে তো ইতিহাসের পাতা। আজ আমাদের চাই
পূর্ণশক্তির সামরিক শাসন। আমার স্বপ্ন একটা ইসলাম-সম্মত সরকার, যেখানে সেনাবাহিনী হবে
মূল শক্তি, ভারতীয় প্রভাব ছিন্ন করে আমরা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে গভীর বন্ধনে আবদ্ধ
হবো।"
ফারুক
ও রেজাউল একে অপরের দিকে তাকালেন, তরুণ এই অফিসারের কথায় অদ্ভুত এক প্রত্যয়ের আভা।
রেজাউল কণ্ঠ নামিয়ে বললেন, “স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বর্তমান সরকার
কীভাবে পড়বে সেই অদৃশ্য ফাঁদে? বিএনপি কোন বিভ্রান্তিতে পড়বে? জামাত-শিবির তো ইউনূসকে
দিয়ে তাদের মতাদর্শ ছড়িয়ে দিয়ে শেষ মুহূর্তে তাকেই সরিয়ে দেবে।"
ফারুক
মৃদু হাসলেন, “এটাই তো আমাদের সুযোগ। আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মাকে ইতোমধ্যে আমরা নির্বাসনে
পাঠিয়েছি। এখন বিএনপি আর ইউনূসের সন্দেহের ফাটল বাড়বে, সেই ফাটলে আমরা আগুন জ্বালাব।
পেছনে থাকবে পাকিস্তানের নিশ্চুপ সমর্থন, ভারতের অস্থির জেলাগুলোতে ছড়িয়ে দেব দাঙ্গার
রহস্যময় বার্তা। তারপর, সময় বুঝে সামরিক অভ্যুত্থান।"
ঢাকার
রাস্তা দিয়ে দুপুরে সাঁই সাঁই করে যায় র্যাবের গাড়ি, রহস্যময় অভিযানের উদ্দেশ্যে।
হঠাৎ সূর্যটা আশ্চর্যভাবে মেঘের আড়ালে ঢুকে পড়ে, আকাশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লালচে কমলার
এক অদ্ভুত আভা। চালকরা জানে না কেন, আচমকা সব গাড়ি ধীরে ধীরে থেমে যেতে থাকে। মুহূর্তের
জন্য সময় যেন স্থির হয়ে গেছে—বাতাসে ভেসে আসে চাপা কান্নার অস্পষ্ট আওয়াজ। সাধারণ
মানুষের বুকের ভেতর ভেসে ওঠে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস, "বিপ্লবের পর তো শান্তি আসার
কথা ছিল, কিন্তু শহর কেন আজ মরুভূমির মতো নীরব হয়ে গেছে?"
দেয়ালগুলো
যেন রহস্যময় কণ্ঠে ফিসফিস করে, "এই শহরে আটকে আছে রক্তের গন্ধ; ১৯৭৫-এ একবার
লাল হয়েছিল, ৫ই আগস্ট আবার রক্তাক্ত, সামনে অপেক্ষা করছে আরেক দুর্যোগের ছায়া..."
কিন্তু কেউ সেটা দেখতে পায় না, কেবল অনুভবে এক শীতল অস্বস্তি তাদের হৃদয়ে গেঁথে যায়।
নির্বাচন ?
অন্যদিকে,
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্থায়ী কার্যালয়ে আলো-আঁধারের রহস্যময় আবহে বসে আছেন প্রধান
উপদেষ্টা প্রফেসর ইউনূস। সামনে মিহি কাগজে লেখা, “নতুন সংবিধানের খসড়া।” তাঁর দু’পাশে
দুজন তরুণ মুখ—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা শরীফ এবং নাশিতা, জামাত-শিবিরের আদর্শ
থেকে উঠে আসা এক নারী নেত্রী। তাদের চোখে স্বপ্ন ও দ্বিধার ছায়া একই সঙ্গে খেলা করে।
“স্যার,
আমাদের আন্দোলনের পর আপনার নেতৃত্বকে মেনে নিয়েছি। কিন্তু নির্বাচনের ব্যাপারে কি
ভাবছেন?”—শরীফের কণ্ঠে জিজ্ঞাসা ও সতর্কতার রহস্যময় মিশেল।
ইউনূস
মৃদু হাসলেন, গলার স্বরে শান্ত অথচ গভীর সংকেত, “দেশের অবস্থা এখনও স্থিতিশীল নয়।
নির্বাচনের ডাক দিলে আবার রক্ত ঝরবে। বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও জনসমর্থন
নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। আমার প্রস্তাব, দুই বছর অন্তর্বর্তী সরকার চালিয়ে পরে নির্বাচন।"
শরীফ
ও নাশিতা একে অপরের চোখে তাকায়। নাশিতা নিচু স্বরে বললেন, “আমরা চাই সংবিধানে শরিয়া
আইন অন্তত পরিবার ও বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়ে স্পষ্ট উল্লেখ থাকুক। ইসলামী মূল্যবোধ ছাড়া
এই দেশের মুক্তি অসম্ভব।"
ইউনূস
নিরুত্তর, শুধু রহস্যময় হাসির ইঙ্গিতে সম্মতি দিলেন।
ওদিকে
বিএনপির অভ্যন্তরে চাপা উত্তেজনার রহস্যময় গুঞ্জন—"নির্বাচনের দাবি তুলতেই হবে,
না হলে ইউনূস ক্ষমতা আঁকড়ে রাখবে।" সামরিক বাহিনী নির্দ্বিধায় খেলছে দ্বৈত ভূমিকা—বাইরে
ইউনূসকে সংযমের পরামর্শ, গোপনে বিএনপিকে উসকানি।
এই রহস্যময়
পরিবেশে কর্নেল ফারুক পাকিস্তানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। মেজর জাহিদের মাধ্যমে
এসেছে বার্তা—ভারতের ভূমিতে তৈরি হতে চলেছে নতুন বিপর্যয়, এবার আর কাশ্মীর নয়। বাংলাদেশের
ভবিষ্যৎ পাল্টানোর জন্য এক গোপন, বড় "উপহার" অপেক্ষমাণ।
এক সন্ধ্যায়
গোপন কক্ষে বসে কর্নেল ফারুক, কর্নেল রেজাউল, মেজর আসাদ এবং অভিজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার সামিম।
দেয়ালে এখনও ঝুলে আছে ১৯৭৫-এর ধূলিমাখা অর্ধছেঁড়া পোস্টার। সামিমের গলায় রহস্যের
মৃদু ফিসফিস, “আমাদের আসল শক্তির উৎস ওই ১৫ আগস্টের রাত। বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা রাতারাতি
শেষ হয়ে যায়—দেশ নতুনভাবে জেগেছিল।"
ফারুকের
গলায় দৃঢ়তা, “কিন্তু সেটি ছিল অসম্পূর্ণ বিপ্লব। আমাদের এবার সম্পূর্ণ জয় চাই। বিএনপি,
ইউনূস, জামাত—সবাইকে ছায়ায় রেখে সেনাবাহিনী হবে প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী।"
মেজর
আসাদ লক্ষ্য করেন সামিমের চোখের গভীরে আরও রহস্যময়, আরও কঠোর পরিকল্পনা। সামিম বললেন,
“বিশ্বের সঙ্গে মিত্রতার মাধ্যমে ভারতকে চাপের মধ্যে ফেলতে হবে। ইউনূসকে ভেতর থেকে
অচল করে বিএনপিকে দিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করব। সেনাবাহিনীই হবে দেশের একমাত্র ত্রাতা।"
সন্ধ্যার
মৃদু আলোয় ঢাকার আকাশে অদ্ভুত এক লালচে-কমলা আলোর রেখা দেখা যায়। পথচারীরা বিস্ময়ে
তাকিয়ে থাকে, যেন দৈববাণী বলছে, "কিছু একটা ঘটতে চলেছে।" ভাঙা রেডিও থেকে
ভেসে আসে পুরনো গানের রহস্যময় সুর।
গলির
কোণে এক কালো বিড়াল মানুষের মতো ফিসফিস করে বলে, “আগস্ট মাস অভিশপ্ত, ১৯৭৫-এর রক্ত
এখনও শুকায়নি!” মুহূর্তেই বিড়ালটি স্বাভাবিক হয়ে পালিয়ে যায়। সত্য-মিথ্যার রহস্য,
বাস্তব-কল্পনার সীমা আজ আর আলাদা নেই, সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত মায়ায় জড়িয়ে গেছে।
পরিণতি
সেই
গোপন সামরিক কক্ষে রহস্যের আবহে মুখোমুখি বসে আছেন কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রেজাউল।
তাদের চোখে স্থির দৃষ্টি, যেন একে অপরের মধ্যে কিছু গভীর সংকেত খুঁজছেন। দুজনের হাতের
মধ্যে কাঁপছে পুরনো এক মানচিত্র—বাংলাদেশের সীমানা জুড়ে আঁকা রহস্যময় চিহ্ন, কোথাও
লাল দাগ, কোথাও কালো। লাল দাগের ভেতরে ছাত্র জনতার উন্মত্ত স্লোগানের প্রতিধ্বনি; কালো
দাগে বিএনপির গোপন শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। আর পুরো মানচিত্র জুড়ে সেনাবাহিনীর শক্তি,
যেন অদৃশ্য মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে আছে অসংখ্য বিন্দুতে।
ফারুকের
কণ্ঠে রহস্যময় দৃঢ়তা, “আমাদের পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে। আওয়ামী লীগ অদৃশ্য হয়েছে,
১৯৭৫-এর প্রেতাত্মারা আজ আর নেই। ইউনূস আর বিএনপি পরস্পরের বিরুদ্ধে রক্ত ঝরাবে, আমরা
শুধু তাদের আগুনে কিছু হাওয়া দেব। তারপর সেনাবাহিনী নামবে মঞ্চে—মোক্ষম মুহূর্তে সকল
কর্তৃত্ব নিয়ে নেবে। বাইরের হস্তক্ষেপ আসলে? পাকিস্তান, চীন—সব দিকেই আমাদের কৌশল
প্রস্তুত থাকবে।”
রেজাউল
ধীর স্বরে যোগ করলেন, “ছাত্র শিবিরের গোপন অস্ত্র সম্পর্কে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।
ওরা ইউনূসকে দিয়ে ইসলামিক রাজত্বের স্বপ্ন দেখছে। এটা আমাদের জন্য সমস্যা হতে পারে,
আবার সুযোগও। মাঠে ওদের উত্তেজনা কাজে লাগিয়ে সহজেই জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে।”
এতক্ষণ
চুপ করে থাকা মেজর আসাদ মুখ খুললেন, তাঁর চোখে এক জ্বলন্ত প্রত্যয়, “স্যার, আমরা যাই
করি না কেন, ইসলামের মর্যাদা যেন রক্ষা পায়। ৭৫-এর অভ্যুত্থান ছিল অসম্পূর্ণ, ভারত
সুযোগ নিয়েছিল। এবার এমন পরিকল্পনা চাই, যাতে বাইরের কোনো শক্তি আমাদের শৃঙ্খলিত করতে
না পারে। আল্লাহ্ চাইলে এ দেশের নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে থাকবে।"
ফারুক
গভীর নিশ্বাস নিয়ে উত্তর দিলেন, “সঠিক বলেছো, আসাদ। আগে নিজেদের ভিত শক্ত করতে হবে।
তারপর সুযোগ বুঝে ক্ষমতা দখল—এবার ১৫ আগস্টের চেয়েও বড় বিজয় হবে, পূর্ণ এবং নিখুঁত।"
কথা
শেষ হতেই ঘরে নেমে আসে এক রহস্যময় নীরবতা। দূর থেকে ভেসে আসে পুরনো ডিজেল জেনারেটরের
শব্দ—যেন কোনো অদৃশ্য দৈত্যের নিঃশ্বাস। দেয়ালের ফাটল দিয়ে সন্ধ্যার শেষ আলো ক্ষীণ
আগুনের রেখার মতো উঁকি দেয়। সময় যেন থেমে গেছে; কেউ জানে না, এই রাতের রহস্য পেরিয়ে
কখন আসবে নতুন দিনের আলো।
প্রত্যাশা
৫ই আগস্টের
বিপ্লবের পর বাংলাদেশের রাজপথ আজ অন্য কোনো দুনিয়ার সীমান্ত যেন। বিএনপি ও ইউনূস মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে—দুই প্রান্তে দুটি বিপরীত মেরু, মাঝখানে মানুষের উদ্বেগের এক বিষণ্ণ নদী।
জামাত-শিবিরের অদৃশ্য হাতের ছায়ায় ইউনূস আপাতত শক্তি পাচ্ছেন, কিন্তু এই শক্তি কতক্ষণ
স্থায়ী হবে, তা এক রহস্য। শহরের বাতাস ভারী, সাধারণ মানুষ ফিসফিস করে বলে—"আবার
কি সামরিক শাসনের রাত নামছে?" কারও চোখে প্রত্যাশা, "আসুক, অন্তত শান্তি
আসবে!" আবার কেউ ভয়ে ভাবে, "১৯৭৫-এর রক্তাক্ত দিনগুলো আবার ফিরছে না তো?"
সেনা
ক্যান্টনমেন্টের বাইরে রাতের আকাশে ঘনিয়ে ওঠে রহস্যময় অন্ধকার, যেন অদৃশ্য কোনো হাত
ঢেকে দিয়েছে শহরের স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা। হঠাৎ কোথাও দেখা যায় অদ্ভুত নীলাভ
আলোর ছোঁয়া, যেন এক অলৌকিক দৃশ্য। মানুষ বলে, ওই আলোয় ভেসে বেড়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫
আগস্টে নিহত শহীদদের আত্মা—তাদের বুকের গভীরে জমা হওয়া কান্না আর প্রতিহিংসার ছায়া।
অথচ আজকের তরুণ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে সেই রক্তাক্ত রাত ‘বিপ্লবের গৌরব’, বিজয়ের
উৎসব। সময়ের রহস্য, ইতিহাসের পরিহাস—একজনের চোখে যা বর্বরতা, অন্যের চোখে সেটাই গৌরব;
একজনের কাছে শহীদ, অন্যের কাছে ষড়যন্ত্রকারী। সময় আজও সেই ধাঁধার উত্তর দিতে ব্যর্থ।
পর্ব-২ ঃ পারমানবিক ছায়া
ভ্রাতৃত্বের বন্ধন
ঢাকা
শহরে গোধূলি নেমেছে এক অদ্ভুত রুপোলি আলোয়। চারপাশের বাড়িঘরের ছাদে দমকা হাওয়া বইছে,
সড়কে তেমন কোলাহল নেই। এই মৌসুমে সাধারণত বৃষ্টি থাকার কথা, অথচ আকাশ কেমন ধূসর, ঝিমধরা।
মনে হয়, সময় যেন কেঁপে কেঁপে চলছে—কোনো অদৃশ্য কল্পনায় রঙিন হয়ে উঠে আবার মলিন
হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক
এই সময়ে কর্নেল ফারুক নিজের কার্যালয়ের নিভু আলোতে মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে অপেক্ষা
করছিলেন। দুটো পর্যন্ত বারবার চেক করা হলো—“টেলেগ্রা” (গোপন বার্তালাপের অ্যাপ, যাকে
সাধারণ মানুষ টেলিগ্রামের বিবর্তিত ভার্সন মনে করে), সেখানে আইএসআই-এর অফিসার ‘মেজর
জাহিদ’ (ছদ্মনাম) থেকে কোনো বার্তা আসার কথা।
হঠাৎ ফোনের পর্দায়
সংকেত ভেসে উঠল:
#Encrypted Message
From: Maj. Zahid (ISI)
To: Col. Faruk (BD Army Intel)
"Brother, are you online? I have
crucial updates re: 'the device'."
কর্নেল
ফারুক গভীর নিঃশ্বাস ফেললেন। ফোনে একটা ভেসে ওঠা নীল অ্যাপ আইকনে স্পর্শ করে তিনি ঢুকলেন
সুরক্ষিত চ্যাটে। সংকেত পাঠালেন:
"I'm here. Ready to talk. Let's
keep it short and coded."
এরপর
কয়েক সেকেন্ড চুপচাপ, যেন রাতের অন্ধকারে কেউ পথ হাতড়ে দেখছে। এরমধ্যেই পর্দার কোণায়
আবার বিলীয়মান টেক্সট ভেসে ওঠে–
Maj. Zahid:
"Weight about 25 kg total. Core
is Plutonium-based. Trigger electronics separate. Built in Pakistan
specifically for infiltration into Kashmir.
Need your readiness to receive."
কর্নেল
ফারুক কিছুক্ষণ কিবোর্ডে টাইপ করলেন, থেমে থেমে। মেজর জাহিদ তখনও অনলাইনে। দুই প্রান্তেই
নিঃশ্বাসবদ্ধ উৎকণ্ঠা।
Col. Faruk:
"25 kg? That’s heavier than
typical portable devices. But workable. Plutonium core—fine.
Which generation? Any known meltdown
risk?"
পাকিস্তানি অফিসার
মেজর জাহিদ রিপ্লাই দিলেন:
"Third-gen design, small yield
~1-2 kiloton. Electronics & chemical explosive triggers are separate to
prevent accidental detonation.
We used these for ‘Kashmir Plan’
once, but never deployed.
Now it’s your call. We are ensuring
safe transit from Karachi to Chittagong.
ETA: 3 weeks."
সঙ্গে-সঙ্গে
কর্নেল ফারুকের মনে একটা অদ্ভুত আনন্দ ও শঙ্কা মেশানো স্রোত বয়ে গেল। ২৫ কেজি ওজনের
প্লুটোনিয়াম কোর—যার চারপাশে কনভেনশনাল এক্সপ্লোসিভ আর ডিটোনেটর সাজানো—এই মারণাস্ত্রের
ক্ষমতা বিপুল, কিন্তু আকারে মাত্র একটা বড় লাগেজ বা সুটকেস সমান। সঠিকভাবে সেট আপ
করলে ১-২ কিলোটন বিস্ফোরণ ঘটানো সম্ভব, যা পুরো একটা অফিসপাড়া বা সরকারি ভবন নিশ্চিহ্ন
করতে যথেষ্ট।
তিনি আবার বার্তা
পাঠালেন:
"Understood. Keep the device
disassembled until final approach.
We’ll handle infiltration route
through BD.
But we need detailed instructions on
the core and the electronics."
মেজর
জাহিদ তখন ডিটেইলস দিতে লাগলেন—কীভাবে প্লুটোনিয়াম পিট (pit) থাকে সুরক্ষিত সিলিন্ডার-আকৃতির
ভিতরে, তার চারপাশে উচ্চবিস্ফোরক লেন্স, যা সমানভাবে চাপ প্রয়োগ করে কোরটিকে
critical mass-এ পৌঁছে দেবে। পাশাপাশি থাকবে ডেটোনেটর সার্কিট, যেখানে অবিচ্ছিন্ন তার
ও নিরাপত্তা লক। কেউ যদি ভুলেও সুইচ চেপে ফেলে, তৎক্ষণাৎ বিস্ফোরণ না হয়ে বরং সিকোয়েন্স
ও কোড লাগবে।
এই সব
বিশদ তারা কোডেড ভাষায় আলোচনা করে নিচ্ছেন—ডানিদিকের স্ক্রল-বারে কিছু আরবিতে ‘সুবহানাল্লাহ’
আর উর্দুতে ‘ইনশাআল্লাহ’ টাইপ শব্দ ব্যবহার করছেন, যেন কেউ সন্দেহ করলে ভাববে ধর্মীয়
কোনো আলোচনা চলছে।
আলোচনায় হঠাৎ কর্নেল
ফারুক মেসেজ পাঠালেন:
"Maj. Zahid, there's a
historical baggage. 1971 war. Our people still hold bitterness about the
genocide.
We also know many in your army
ridiculed us as “betrayers.”
But times have changed. Let’s unify
as Muslim brothers."
অন্যপ্রান্তে মেজর
জাহিদ খানিকক্ষণ নীরব, তারপর উত্তরে লিখলেন:
"Yes, 1971 was a tragedy. Some
of our men did commit crimes, rapes, atrocities.
On behalf of Pakistan, I sincerely
regret and apologize for that part of history.
But India engineered that separation.
They used you to break one Pakistan.
Today, let's stand together
again."
কর্নেল
ফারুকের মনে দ্রুত উঁকি দিল অনেক পুরনো ক্ষোভ আর নানারকম প্রোপাগান্ডার কথা—আওয়ামী
লীগের বক্তব্য ছিল, পশ্চিম পাকিস্তান নাকি পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে আর স্বাধীনতা
আন্দোলন ন্যায়সংগত ছিল। আবার সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অনেকেই বিশ্বাস করে, ভারত সেই
সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের আবেগকে হাতিয়ার বানিয়েছিল।
ফারুক পরের বার্তায়
লেখেন:
"History is complex. Awami
propaganda said East Pakistan contributed 24% GDP but got less budget
allocation.
But we know 5-year plans were giving
more than 50% fund to East Wing.
Numbers were twisted.
India exploited that.
They forced us to be ‘secular
Bangladesh’.
Now is payback time for Indian
dadagiri."
মেজর জাহিদ সায় দিলেন:
"Exactly. They keep occupying
Kashmir, repressing local Muslims, grabbing Wakf properties.
We have to avenge.
This suitcase nuke is a sign that our
ummah can strike back if needed."
মেসেজের পর মেজর
জাহিদ আরেকটি অডিও ক্লিপ পাঠালেন যেখানে তিনি বলছেন, “We stand together, brother
Faruk. May this operation remind India not to toy with us.”
কর্নেল
ফারুকের চোখে এক চিলতে উল্লাসের ঝিলিক দেখা গেল। তাঁর মুখের কোণে কঠিন এক হাসি—“৭১-এর
জ্বালা কিছুটা ভুলিনি, কিন্তু আগামীর ক্ষমতার জন্য আমরা একসঙ্গে কাজ করব।”
পৃথিবীতে
কেউ জানল না, রাতের গভীরতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই কর্মকর্তা আর পাকিস্তানের আইএসআই-এর
লোক কীভাবে নিঃশব্দে একাত্ম হলো। ফোনের পর্দায় আলো ঝিলিক দিয়ে উঠল, তারপর আবার নিবে
গেল। একটা পরমাণু ছকের বীজ বপন হয়ে গেল এ মাটিতে।
হঠাৎই ক্যান্টনমেন্টের বাইরে আকাশে একটা অদ্ভুত
নীলাভ অরণ্যের ছায়া —যেন নিঃশব্দে ভাসমান কোনো অভিশপ্ত দৈত্যের ছায়া ক্রমে শহরের
ওপর নেমে আসছে। পেঁচার ডাক শোনা গেল অনেক রাতে, অথচ ঢাকার শহরে পেঁচা সচরাচর দেখা যায়
না। কেউ কেউ বলে, “এটা অশনি সংকেত,” আবার কেউ দেখে না, ঘুমে তলিয়ে যায়।
এই গোপন
চুক্তির সঙ্গে যেন প্রকৃতিও চাপা ভাবে কেঁপে ওঠে—অদূরে কুকুরের একটা থেমে থেমে কান্নার
মতো শোনা যায়, বাতাসে ধুলো জেগে ওঠে। মানুষ বুঝতে পারে না, এ শহরের ওপরে এক মহাসংকট
ধেয়ে আসছে।
প্রতিশোধ
পরের
রাতে কর্নেল ফারুক একা গাড়িতে অফিস থেকে ফিরছিলেন। রাস্তাগুলো যেন বিষণ্ণ, ল্যাম্পপোস্টের
আলো মাঝে মাঝে নিভে যায়—শহরটা যেন কোনো গোপন পাপের নীরব সাক্ষী। মোবাইলের স্ক্রিনে
আবার ভেসে উঠল মেজর জাহিদের বার্তা। অন্ধকারে ঘেরা বার্তাগুলো যেন আরও স্পষ্ট, আরও
ভয়ংকর। সেখানে বিস্তারিত লেখা: "বিশেষ এই প্লুটোনিয়াম বোমাটি তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানের
ফেডারেল ল্যাবরেটরিতে—মূলত কাশ্মীরের জঙ্গিদের জন্য, ভারতের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটিগুলো
লক্ষ্য করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চাপের কারণে দীর্ঘদিন এটি ছিল অব্যবহৃত, নিশ্চল।"
গাড়ির
জানালার বাইরে তাকিয়ে ফারুক ভাবেন, মানব ইতিহাসের গভীরে কতবার এমন ভয়াবহ পরিকল্পনার
জন্ম হয়েছে? কত মানুষ ক্ষমতা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষার মোহে নিজেকে ন্যায়-অন্যায়ের দ্বন্দ্ব
থেকে মুক্ত করে নিয়েছে? হঠাৎ এক গভীর বিষণ্ণতা তাঁর মনে ছায়া ফেলে। তিনি কি আসলে
এক অদৃশ্য শক্তির হাতে নিয়ন্ত্রিত পুতুল ছাড়া কিছুই নন? তাঁর জীবনের অর্থ কী—যদি
তা শুধু প্রতিশোধ ও ক্ষমতার দাসত্বেই সীমাবদ্ধ থাকে?
পাকিস্তানের
সামরিক কর্তারা এতদিন বড় ধরনের পারমাণবিক হামলার সাহস দেখায়নি। আমেরিকা, চীন ও সৌদি
আরবের চাপেই তারা থেমে ছিল। কিন্তু এই ছোট সরঞ্জাম অন্য দেশে পাঠানো—গোপন, ছদ্মবেশী
যুদ্ধের মতো, যেখানে পাকিস্তান সহজেই দায় এড়াতে পারবে। সরাসরি তারা বলবে, "এটি
সন্ত্রাসীদের হাতে গেছে, আমাদের জানা নেই!" ভারত যদি প্রতিশোধ নিতে চায়, আন্তর্জাতিক
মহলে প্রমাণের অভাবে তারা অসহায় হবে অথবা চীনের ভেটোতে আটকে যাবে।
ফারুকের
হৃদয়ে উত্তেজনা জাগে, কিন্তু সেই উত্তেজনার নিচে লুকানো এক অদ্ভুত শূন্যতা তাঁকে ধীরে
ধীরে গ্রাস করে। ক্ষমতার এই নিষ্ঠুর খেলায় কি তিনি নিজের আত্মাকে হারিয়ে ফেলেছেন?
মুখে মুখে ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের কথা বললেও, তাঁর ভেতরে জ্বলছে কেবল ক্ষমতার নির্মম আগুন—যার
লেলিহান শিখা তাঁর নিজের মানবতাকেও পুড়িয়ে দিচ্ছে।
ইসলামাবাদে
বসে আইএসআই-এর কর্মকর্তারাও নির্লিপ্তভাবে নিজেদের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে, ঠান্ডা মাথায়
হিসাব কষছে। তারা জানে বাংলাদেশের ভেতর অনেকেই ভারতের প্রতি গোপন বিদ্বেষ পোষণ করে।
তাদের হাতিয়ার বানিয়ে ভারতকে ঘায়েল করা সম্ভব। কিন্তু এই ভয়ংকর খেলা কি শেষ পর্যন্ত
তাদেরও রেহাই দেবে? একদিন হয়তো তারাও এই একই চক্রের শিকার হবে।
মধ্যরাতের
নীরবতায়, গোপন টেলিগ্রাম মেসেজিং চ্যানেলে একটি মাত্র শব্দ বারবার ভেসে আসে, অন্ধকারের
বুক চিরে যায়—“Revenge” (প্রতিশোধ)। ১৯৭১-এর ক্ষত, কাশ্মীরের আক্রোশ, ধর্মীয় নিপীড়নের
ক্রোধ—এসব মিলিয়ে সৃষ্টি হয়েছে এক জটিল ও নিষ্ঠুর ঐক্যের। এই প্রতিশোধস্পৃহা কি আসলে
মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে গভীর ট্র্যাজেডি নয়?
ক্ষতের দাগ
কর্নেল
ফারুকের ড্রয়িংরুমটা আজ অদ্ভুতভাবে নীরব, রহস্যময়। সন্ধ্যার ম্লান আলোয় প্রাচীন
দেওয়ালগুলো যেন অদৃশ্য বোঝার ভারে নুয়ে পড়েছে। দেয়ালে ঝোলানো এক বিবর্ণ ছবি—১৯৬৪
সালে তোলা এক পারিবারিক মুহূর্ত, সেখানে ফারুকের বাবা, তখন পাকিস্তানি সামরিক পোশাকে
গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। ছবিতে ফুটে আছে এক অদ্ভুত অহংকারের ছায়া, যেন ইতিহাসের
ভাঙা দর্পণে প্রতিফলিত বিস্মৃত মহত্ত্ব। সময়ের সাথে গর্বের সেই মুখাবয়ব আজ কেমন বিষণ্ণ,
করুণ হয়ে উঠেছে।
সন্ধ্যার
নির্জনতায় হঠাৎ কর্নেল রেজাউলের গলা ভেসে এল, ধীর, সতর্ক। "ফারুক, শোনো। আইএসআই-এর
সাহায্য নেওয়ার ব্যাপারটা সত্যিই কি সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে? ১৯৭১-এর ক্ষত এখনো
মানুষের মনে তাজা। লক্ষ লক্ষ নারীর সম্ভ্রমহানি হয়েছে ওদের হাতে, আমাদের বাড়িঘর আগুনে
পুড়েছে—এই স্মৃতি কি এত সহজে মুছে যাবে?"
ফারুক
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তাঁর দৃষ্টি যেন অতীতের গহীন অন্ধকারে হারিয়ে গেছে। কিন্তু গলার
স্বরে অদ্ভুত দৃঢ়তা, যেন ইতিহাসের বিচারের ভয় তাঁকে স্পর্শ করে না। "সময় পাল্টে
গেছে, রেজাউল। ভারত বরাবরই আমাদের দমিয়ে রাখতে চেয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে।
তারা আমাদের স্বাধীনতাকে ‘সেকুলার বাংলাদেশ’ নামের মুখোশে ঢেকে নিজেদের আজ্ঞাবহ করে
রাখতে চায়। এই অবস্থা থেকে মুক্তির জন্যই আমাদের দরকার শক্তিশালী মিত্র—পাকিস্তান,
চীন—ঐতিহাসিক ক্ষোভ ভুলে আজ মুসলিম ভ্রাতৃত্বের নামে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো ছাড়া
অন্য পথ নেই।"
বারান্দার
জানালার পাশে দাঁড়ানো মেজর আসাদের চোখ আকাশের দিকে—সেখানে সন্ধ্যার শেষ আলো মিলিয়ে
যাচ্ছে। তাঁর কণ্ঠে রহস্যময় এক ঘোর। "আল্লাহর ইচ্ছার সামনে আমাদের অতীত কেবলই
এক ‘মিসগাইডেড’ অধ্যায়। ভারতীয় ষড়যন্ত্র আর আওয়ামী প্রোপাগান্ডার জাল ছিঁড়ে বেরোতে
পারলেই আমরা সত্যিকার অর্থে উম্মাহর ঐক্যের পথে যেতে পারব। এই সময়ে পাকিস্তানি ভাইদের
সাথে হাত মিলিয়ে ভারতকে যদি প্রকৃত শিক্ষা দেওয়া যায়, পরবর্তী প্রজন্ম জানবে—আমাদের
মুসলিম উম্মাহ ছিল অটুট, আছে অটুট।"
ঘরে
নিঃশ্বাস আটকে থাকা এক নীরব উত্তেজনা। যেন অনাগত কোনো ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে তিনজন মানুষ, যাদের আত্মা শিকলে বাঁধা নিয়তির অন্ধকার পথে। আলো-আঁধারিতে যেন
ভেসে উঠছে তাদের গোপন আলোচনার শেষ প্রশ্নটা, নিষ্ঠুর, নির্মম—"আচ্ছা, এই সুটকেস
বোমার বিস্ফোরণ ঠিক কোথায় ঘটানো হবে? আসাম সেক্রেটারিয়েট নাকি পশ্চিমবঙ্গ?"
ইউনুসের ভবিষ্যত
বিএনপির নেতারা প্রকাশ্যে
ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে মিছিলে—“নির্বাচন দাও! বৈধ সরকার আনো!”
ইউনূসকে পেছন থেকে জামাত-শিবির সাময়িক সমর্থন দিলেও
ভেতরে ভেতরে সন্দেহ বাড়ছে—“ইউনূস আসলে কতটুকু ইসলামী আদর্শে বিশ্বাস করে?”
উপাচার্যের
বাসভবনে একদিন সন্ধ্যায় শিবির-নেতা রবিউল আরেক ছাত্রনেতা তারেককে বলছে, “দেখো ভাই,
আমরা ইউনূস সাহেবের পক্ষে আছি, কারণ উনি আওয়ামী-বামপন্থী ঘরানাকে ভেঙেছেন। কিন্তু
ওনার চেহারা তো জাপানি স্যুট-পরা, বিদেশি ইংরেজিতে কথা বলা ধনী লোকের মতো। কতটুকু ধর্ম
চর্চা করেন, সন্দেহ! কাজেই সামনের দিনে যদি সামরিক বাহিনী ওনাকে পালটে কোনো ইসলামপন্থী
সরকার গড়ে, সেটাকেই স্বাগত জানাব।”
চারদিকে
এখন এক রহস্যময় হাওয়া—রাজনৈতিক দলগুলো মেরুদণ্ডহীন, ষড়যন্ত্রের দানা ঘনীভূত, আর
সাধারণ মানুষ ধুলো-বালির মাঝে দিকভ্রান্ত।
আবার টেলিগ্রা বার্ত্তা
কর্নেল ফারুক অফিসে ঢুকেই দেখলেন, ফোনে বার্তা এসেছে:
Maj. Zahid (ISI):
"Device is ready.
Weight 25kg, disassembled into 2 main modules.
Ship departing Karachi in
2 days, en route via Chinese cargo.
Landing Chittagong next
full moon.
We will mask the shipment
with textile machinery invoice."
“Next full moon”—শুনে কর্নেল ফারুকের
ছোঁয়া লাগে। চাঁদের আলো নাকি পাপ ঢেকে দেয়, অথবা কখনও অমাবস্যায় পাপ জেগে ওঠে? এ
কোন পৌরাণিক দৃশ্য ? তিনি চিন্তা করেন, চতুর্দশীর রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে চীনা জাহাজ
এসে ভিড়বে, আর সেই স্রোতে চলে আসবে ছোট্ট পারমাণবিক ডিভাইস।
তিনি জবাবে লেখেন:
Col. Faruk:
"Perfect. We have
partial clearance at Chittagong.
We’ll bypass standard
scanning.
Make sure no leaks or
suspicious labeling on the container.
Our men will meet your
handler.
Any final words from your
HQ?"
মেজর জাহিদ:আবার লিখে পাঠিয়েছেন,
"HQ instructs me to
ensure strategic & ideological alignment.
We view your operation as
part of grand jihad against Indian aggression.
And about 1971, as I said,
we are sorry for that era, let’s move forward as one ummah."
এই কথাগুলো
আবার কর্নেল ফারুকের মনে পুরনো আবেগ উসকে দেয়—কিন্তু তিনি হৃদয়ের গভীরে জানেন, এসব
কেবলই কূটনীতির নিখুঁত ছলনা। সত্যিই কি পাকিস্তান ১৯৭১-এর ভয়াবহ গণহত্যার জন্য আন্তরিকভাবে
ক্ষমা চাইতে পারে? নাকি তাদের এই কথাগুলো শুধুই সুবিধার সময়ে মুখে মিষ্টি লাগানো ছাড়া
কিছুই নয়? তবুও এক অদ্ভুত নিয়তির তাড়নায় তিনিও এই নাটকের অংশ হয়ে আছেন, নিজের
প্রয়োজনের জন্যেই তাঁকে চালিয়ে যেতে হচ্ছে বন্ধুত্বের এই অভিনয়।
ফারুক
প্রায় নীরবে মাথা দোলান, যেন নিজের অন্তরের ভেতরের দ্বন্দ্বকে বোঝাতে চাইছেন—"যা
করা লাগবে, তা-ই করব।"
এক সন্ধ্যায়
সেনানিবাসের ক্যান্টিনে কর্নেল রেজাউল ও মেজর আসাদ চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে
গভীর আলোচনায় ডুবে আছেন। আলোচনায় বারবার উঠে আসছে ভারতের প্রসঙ্গ—কাশ্মীর, মুসলিম
নিপীড়ন, ওয়াকফ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত—এসব প্রসঙ্গে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলেন আসাদ:
“দেখুন
স্যার, ভারত আমাদের মুসলিম ভাইদের উপর কতটা নির্যাতন চালাচ্ছে। কাশ্মীরে প্রতিদিনের
কারফিউ, পশ্চিমবঙ্গে গরু জবাই নিয়ে সংঘর্ষ, হিন্দুত্ববাদের নগ্ন দাপট—এই দেশকে একটা
শক্ত ধাক্কা না দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সংস্কৃতি, অর্থনীতি, ব্যবসা—সব জায়গায়
ভারতের দাপট বেড়েই চলেছে, আমাদের স্বাধীনতা বিপন্ন!”
রেজাউল
মাথা নেড়ে মৃদুস্বরে বললেন, “ঠিক এই কারণেই তো ISI-এর সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ। সুটকেস
বোমার পরিকল্পনা রয়েছে বটে, কিন্তু আমরা কি সত্যিই তার প্রকৃত নিয়ন্ত্রক? নাকি তারা
ভারতকে আঘাত করার জন্য আমাদের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছে? ক্ষমতা দখলের পর আমাদের উদ্দেশ্য
হবে ভারতকে এমন শিক্ষা দেওয়া, যাতে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে, আর অবশ্যই
চীনকে পাশে রাখা।”
ক্যান্টিনের
কাচের জানালায় দূরের কোনো ফ্যান্টাসমাগরিক আলোকরশ্মি প্রতিফলিত হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে
দূরে কোথাও জ্বলছে আগুন, ক্ষীণ এক অশুভ আগুন। চায়ের গরম ভাপ জানালার ঠান্ডা কাচে গিয়ে
ছোট ছোট ফোঁটায় জমা হচ্ছে। ফোঁটাগুলো ধীরে ধীরে অদ্ভুত সব আকার নিচ্ছে—কখনো মনে হচ্ছে
মানচিত্রের মতো, কখনো কাশ্মীরের উপত্যকার মতো, কখনোবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের অদ্ভুত
বিভাজনের মতো। কেউ লক্ষ্য করছে না, আবার কেউ দেখলে হয়তো ভয়ে কেঁপে উঠত—"এ কেবলই
কি কাকতালীয়, নাকি গোপন কোনো পূর্বাভাস?"
শেষরাতে
কর্নেল ফারুক আরেকটি গোপন বার্তা পেলেন, এইবার পাক-সেনারই আরেক র্যাঙ্কিং অফিসার—‘ব্রিগেডিয়ার
মালিক।’ তাঁর বক্তব্য সংক্ষিপ্ত:
"Brother, remember:
For too long India has bullied us—Kashmir, East Pakistan.
They still boast about
1971.
Now we will show them we
can strike anywhere.
May Allah guide us to
victory."
ফারুক প্রতিউত্তরে
লিখলেন:
"Ameen. Let us
correct the mistake of ‘71 that India orchestrated.
Bangladesh was used as
their puppet.
Time to fix that.
Suitcase is a small start,
but it’s powerful enough for a big message."
“Suitcase
is a small start”—প্রচণ্ড ঠাণ্ডা আর নির্মম এই কথাগুলো যেন তাদের অন্তরের গভীরে লুকানো
অন্ধকারকে আরও উসকে দেয়। আগুনে পুড়ে যাওয়া অতীতের স্মৃতিগুলো যেন একবারে নিশ্চিহ্ন
করার এই প্রচেষ্টা। শোষণ, প্রতারণা আর পরাজয়ের তিক্ততা—এসবের প্রতিশোধ নেওয়ার এই
নিস্তব্ধ, অদৃশ্য লড়াই যেন মানুষের আত্মার সবচেয়ে গভীর গহ্বরে জমে থাকা বিষের প্রকাশ।
ভারত
তার নিজের সংকটে নিমগ্ন—কাশ্মীরে সন্ত্রাস দমনে ব্যস্ত, বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে
তাদের ধারণা অস্পষ্ট। ৫ই আগস্টের সাম্প্রতিক আন্দোলন এবং ইউনূস সরকারের পতনের সম্ভাব্য
পরিণতি নিয়ে দিল্লিতে কেউ কেউ উৎকণ্ঠিত বটে, কিন্তু কেউ পুরোপুরি বুঝতে পারছে না—পাকিস্তান
ও বাংলাদেশের গোপন আঁতাতে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে।
চীন,
ছায়ার মতো এক কৌশলী শক্তি, সবসময়ই ভারতের ব্যস্ততা চায়। কারণ তাদের লক্ষ্য এই সুযোগে
এই অঞ্চলে নিজের আধিপত্য বিস্তার করা। বন্ধুত্বের ছদ্মবেশে তারা পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ,
উভয় পক্ষকেই সন্তুষ্ট করে চলেছে। আর পশ্চিমের নজর তখন দূরের মধ্যপ্রাচ্যে, যেখানে
তাদের নিজেদের স্বার্থে আরেকটি জটিল দাবার খেলা চলছে। এই অস্থির বাস্তবতার মাঝে মানুষ
নিজেকে প্রশ্ন করে—সত্যিই কি এই সমস্ত পরিকল্পনার শেষ আছে, নাকি ক্ষমতার এই নিষ্ঠুর
খেলা চিরন্তন?
আজানের ভূতুড়ে আওয়াজ
ঢাকার
পুরোনো এক মসজিদের মিনার থেকে এশার আজান ভেসে আসে। আজানের সুরে আজ কিছুটা অস্বাভাবিকতা,
যেন অতীতের গোপন রহস্যময় ফিসফিসানি মিলেছে ভবিষ্যতের কোনো অদ্ভুত ধাতব প্রতিধ্বনির
সাথে। কয়েকজন মানুষ এই অলৌকিক সুরে বিভোর, বাকিরা বিস্ময়ে ভাবছে, আজানের স্বরে এমন
‘সায়েন্স ফিকশন’ ধ্বনি কোথা থেকে এল? যেন অলৌকিক কোনো সংকেত এই নগরের উপর নেমে আসছে।
ঠিক
এই মুহূর্তে কর্নেল ফারুক আর রেজাউল সামরিক গাড়িতে বেরিয়ে পড়লেন। উদ্দেশ্য সেই রহস্যময়,
গোপন ডেরা, যেখানে পৃথিবীর বাস্তবতা আর কল্পনার মধ্যে রেখাটি ক্ষীণ হয়ে যায়। গাড়ির
রেডিও নিজে থেকেই চালু হয়ে বেজে ওঠে এক প্রাচীন গান—“ও নদীরে, একটি কথা শুধাই শুধু
তোমারে…”। মুহূর্তেই গানটি থেমে যায় এবং অদ্ভুত এক স্ট্যাটিক আওয়াজের মাঝে স্পষ্ট
শোনা যায়—"Nuclear... Nuclear..."। পরক্ষণেই আবার নেমে আসে নিঃসীম নীরবতা।
মেজর আসাদ অবাক হয়ে ভাবেন, "এ কি আল্লাহর গোপন ইচ্ছার সংকেত, না কি শয়তানের
কোনও প্ররোচনা?"
গাড়িতে
বসা ব্রিগেডিয়ার সামিম নীরবে হাসেন, তাঁর মুখে আশ্চর্য নিশ্চিন্ততা: "যে করেই
হোক, এবার ভারতকে জবাব দিতে হবে।"
অন্যদিকে
শহরের অপর প্রান্তে, এক পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের ছাদে বসে আছেন এক নিঃসঙ্গ কবি। রাতের
তারাভরা আকাশে তিনি দেখেন এমন কিছু যা অন্য কেউ দেখেনি। তাঁর ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি,
যেন তিনি মানবজাতির পুরোনো ভুল আর ধ্বংসের পুনরাবৃত্তিকে স্বাগত জানাচ্ছেন। তিনি আপন
মনেই বলে ওঠেন, "যদি ধ্বংসই অনিবার্য হয়, তবে নেমে আসুক। আমরা নীরব দর্শক, আমরা
কেবলই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি।"
তিনি
আকাশের দিকে হাত তুলে দেখেন, একটি উল্কাপিণ্ড আগুনের রেখা টেনে দক্ষিণ আকাশে খসে পড়ে।
সেই আগুনের রেখা যেন ভবিষ্যতের রক্তপাত, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার ছায়া এবং অবধারিত
মৃত্যুর ভয়ঙ্কর ভবিষ্যদ্বাণী করে যায়।
তৃতীয় অধ্যায়
ঃ যাত্রাপর্ব
বন্দর থেকে ঢাকার দিকে
চট্টগ্রামের বন্দর সেই রাতে যেন নিঃশব্দ
কোনো থিয়েটারের মঞ্চ, যেখানে দৃশ্যমান কিছু নেই, কিন্তু বাতাসে ছড়িয়ে আছে অজানা
উত্তেজনা। নোঙর বাঁধা জাহাজগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে, কুয়াশায় মোড়া আলোগুলো যেন চোখের
ইশারায় কিছু বলতে চাইছে। আগের রাতের ঠিক শেষ প্রহরে, অন্ধকারে ঢাকা বন্দর চত্বরে ঢুকে
পড়ে একটি পুরনো ট্রাক। তার পেছনে ধীরে ধীরে ওঠানো হয় এক ধূসর ধাতব বাক্স—কোডনাম:
“ব্রিফকেস।” কোনো স্ক্যান, কোনো জিজ্ঞাসাবাদ নয়—সবকিছু যেন পূর্বনির্ধারিত, এক অলিখিত
চুক্তির মতো। বন্দরের পুলিশ নিঃশব্দ, কর্মকর্তারা অদৃশ্য, আর সেনা পাহারায় নিয়োজিত
কিছু চোখ যেন ঘুমিয়ে পড়েছে ইচ্ছাকৃতভাবে।
ট্রাকের ভেতরে ছায়ায় মোড়া পরিবেশ।
চাদরে ঢাকা বাক্সটির দিকে চেয়ে কর্নেল রেজাউল নিচু স্বরে উচ্চারণ করলেন, “আসসালামু
আলাইকুম… শান্তিই আসুক আমাদের পরিকল্পনায়, ইনশাআল্লাহ।” তাঁর কণ্ঠে ছিল অবিচলতা, কিন্তু
চোখের নিচে কালি যেন অতিরিক্ত বোঝার ভার বহন করে। পাশে বসা ক্যাপ্টেন সামীউল খানিকক্ষণ
থেমে থেকে বললেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম, স্যার… আল্লাহ্র নামে শুরু করলাম, সফল হব ইনশাআল্লাহ।”
তাঁর কণ্ঠে উৎসাহের চেয়ে বেশি ছিল এক অজানা স্রোতের ভয়।
এই বাক্সের ভেতরে কী আছে, তা জানে না
ক্যান্টনমেন্টের বেশিরভাগ জওয়ান। কিন্তু কিছু অভ্যন্তরীণ সূত্র জানে, বাক্সটি বহন
করছে প্লুটোনিয়াম কোর, ডিটোনেটর, আর একটি ক্ষুদ্র পারমাণবিক বিস্ফোরকের মূল কাঠামো।
বাইরে থেকে এটি একটি সাধারণ ধাতব বাক্স, কিন্তু তার অভ্যন্তরে জমে আছে শতাব্দীর সবচেয়ে
শীতল মৃত্যু।
ট্রাক ছেড়ে দেয় বন্দর এলাকা, অন্ধকার
চিরে ধীরে ধীরে ঢাকার দিকে এগোয়। শহরের ঘুমন্ত বাতাসে হঠাৎ হালকা ঝড়ের শব্দ ওঠে,
কেউ জানে না কেন। এক বেওয়ারিশ কুকুর হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে, আর বন্দরের একটি বাতি হঠাৎ
নিভে যায়—যেন অদৃশ্য কেউ আঙুল ছুঁয়ে বলল, "এখন শুরু হোক ইতিহাসের নতুন অধ্যায়।"
ট্রাকের চাকা যেন ঢাকার দিকে নয়, সময়ের
গভীরে এগোচ্ছে।
গোপন ঘাঁটিতে
ঢাকায় পৌঁছাতেই ট্রাকটি থামল এক রহস্যময়,
নির্জন ওয়ারহাউসের সামনে—অন্ধকারে ঢাকা, যেন শহরের অগোচরে লুকিয়ে থাকা অচেনা এক পৃথিবী।
বাতাসে যেন কান্নার মতো দীর্ঘশ্বাস, মাটির নিচে কোনো অজানা রহস্যের ফিসফিস। সেই নিঃশব্দ
রাতে ফোন হাতে নিলেন কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রেজাউল।
টেলেগ্রামে কর্নেল ফারুকের বার্তা ভেসে
উঠল, “আলহামদুলিল্লাহ, বন্দরে কোনো বাধা আসেনি। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুর্শিদাবাদ হয়ে
জলপাইগুড়ি, তারপর গৌহাটি। সেখানেই আমাদের সেফ হাউস প্রস্তুত।”
কর্নেল রেজাউলের কণ্ঠে সতর্ক সংশয়ের
ছোঁয়া, “জি স্যার, কলকাতার সেল মুর্শিদাবাদে আমাদের অপেক্ষায় আছে। প্ল্যান পরিবর্তনের
সম্ভাবনা নেই তো?”
ফারুক শান্ত অথচ দৃঢ়স্বরে উত্তর দিলেন,
“এখনও সব স্থির। বিএনপি আর জামাত আমাদের এই অভিযানের পেছনে আছে—কিন্তু তারা জানে না
প্রকৃত সত্য। ওদের কাছে এটা শুধুই ‘বড় বিস্ফোরক’, এর আসল শক্তি অদৃশ্য। সাবধানতার
সাথে এগিয়ে যাও।”
রাতের স্তব্ধতার মধ্যে হঠাৎ শোনা গেল
একটি কুকুরের দূরবর্তী ডাক—যেন প্রকৃতি কিছু একটা বুঝতে পেরে সতর্ক করছে। ওয়ারহাউসের
বাইরে একটি ভাঙা ল্যাম্পপোস্টের আলো হঠাৎ নিভে গেল, যেন অদৃশ্য কোনো হাত রাতের বুকে
এক রহস্যময় স্বাক্ষর এঁকে দিয়ে -
মুর্শিদাবাদের শাহাবুদ্দিন “ভাই”
মুর্শিদাবাদ
যেন ইতিহাসের রহস্যময় এক আবর্ত, যেখানে সময় ও ক্ষমতা পরস্পরের সঙ্গে খেলা
করে। এই অঞ্চলের প্রভাবশালী এমএলএ সাজিদুর রহমান—কাউকে চোখের ইশারায় ক্ষমতার কেন্দ্রে
টেনে আনেন, আবার কারও ভাগ্যে রচনা করেন নীরব বিস্মৃতি। স্থানীয় জনগণের কাছে তিনি একই
সঙ্গে শ্রদ্ধা ও ভয়ের প্রতীক; যেন অন্ধকার ও আলোর সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রহস্যময়
চরিত্র।
সাজিদুরের ছায়াসঙ্গী, তাঁর ডানহাত—শাহাবুদ্দিন
'ভাই'। মানুষের মুখে মুখে ফেরে তাঁর নাম, যেমন ফেরে কোনো প্রাচীন মিথ। গরু পাচার, মাদক
বাণিজ্য, ভোটকেন্দ্র দখলের মতো গোপন আর প্রকাশ্য সবকিছুর নিয়ন্তা তিনি। পুলিশ, রাজনৈতিক
নেতা—সবাই যেন তাঁর অদৃশ্য সুতোয় বাঁধা। মাঝেমধ্যে রসিকতার ছলে শাহাবুদ্দিন বলেন,
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইসব, আমাদের উম্মাহর জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখি আসলে নেতা-নেত্রীদের
খেদমত করতে হয়। আল্লাহ্ knows best!” তাঁর কথায় লুকানো থাকে এক আশ্চর্য বিদ্রূপ,
যা সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে।
সম্প্রতি তাঁর কাছে এসেছে এক রহস্যময়
বার্তা—ঢাকা থেকে আসছে এক ‘বড় মাল’, গোপন নাম 'ব্রিফকেস'। সাজিদুর রহমানের কথায় ইঙ্গিতের
রহস্য, “পুলিশকে সামাল দিস, নিজের ভাগ বুঝে নিস। ভালো লাভ হবে।”
শাহাবুদ্দিন জিজ্ঞেস করেন, "এই ব্রিফকেসের
ভেতরে কী? অস্ত্র না ডলার?" সাজিদুরের ঠোঁটে তখন রহস্যময় হাসি, যেন ইতিহাসের
গোপন পাতা উল্টে তিনি উত্তর দেন, “সবকিছুই জিহাদের নামে, কিন্তু আসলে ক্ষমতার জটিল
খেলাই চলছে। যত কম জানবি, তত বেশি নিরাপদ। উপরে উপরে ইসলামের জন্য লড়াই—আসলে রাজনীতির
গভীর সমুদ্র। তবু তুই কাজ করবি… টাকা পেয়ে যাবি, পুলিশও তোরই হবে।”
শাহাবুদ্দিন নিজের হাসিটুকু চাপা দিয়ে
সম্মতি জানান। তাঁর কাছে ধর্ম আর ক্ষমতা একই মুদ্রার দুটি পিঠ—প্রয়োজন মতো একে অন্যের
আড়ালে লুকিয়ে থাকা সহজ। তিনি জানেন, কখন হিন্দু-মুসলমানের বিভেদের আগুনে তেল ঢালতে
হবে, কখন ভোটের নামে দাঙ্গা বাধিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে হবে। পুলিশ, নেতা, ধর্ম—সবই
তাঁর কাছে ক্ষমতার বিশাল ক্যানভাসে আঁকা মাত্র একেকটি রেখা।
স্থানীয় চোরাচালান সিন্ডিকেট
ঢাকা থেকে সীমান্তের দিকে এক গোপন যাত্রা।
পঞ্চগড়-দিনাজপুরের দিকে অন্ধকারের ভেতরে ট্রাক এগোয় নিঃশব্দে, যেন এক রহস্যময় প্রেতযাত্রা।
গন্তব্য—পদ্মার পাড়, নাম নারায়ণপুর ঘাট। শাহাবুদ্দিনের
লোকজন অপেক্ষায় থাকে, ফোনে গোপন সংকেত, হাতে-পায়ের পুরোনো ইশারায় যোগাযোগ হয়। রাত
গভীর হলে পদ্মার বুকে ছোট নৌকা নিঃশব্দে ভেসে যায়, যেন মৃত্যু আর রহস্যের মাঝখানের
এক দোলাচল।
ঘাটের পাশে বিশাল ধানখেতের মাঝখানে ট্রাকটি
এসে থামে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে শাহাবুদ্দিন, গায়ে চেক লুঙ্গি, হালকা শার্ট—চোখে তীক্ষ্ণ
ক্যাচর-ম্যাচর দৃষ্টি, যার অর্থ অনেক গভীর। পাশে পাঁচ-ছয়জন সশস্ত্র কর্মী, সবার মুখে
আতঙ্ক আর লোভের অদ্ভুত মিশ্রণ।
বাক্সটি সাবধানে নামানো হলে শাহাবুদ্দিন
ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঢাকাই উচ্চারণে বলেন, “আসসালামু আলাইকুম ভাইসব। আপনেগো ঢাকা থিকা
আসছেন, ঠিক তো? কী অবস্থা?”
ঢাকার ক্যাপ্টেন সামীউল সাবধানী গলায়
বলেন, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। শাহাবুদ্দিন ভাই, বস্তুটা গুরুত্বপূর্ণ, সাবধানে চালাইবেন।
আপনাদের কলকাতার গ্রুপ আমাদের সাথে আছে, ভুলবেন না।”
পাশ থেকে একজন কর্মী ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “ভাই,
ভিতরে কী এমন আছে?”
শাহাবুদ্দিন চোখ কুঁচকে গলা নামিয়ে বলে
ওঠেন, “চুপ থাক, বেটা! বেশি জানবার দরকার নাই। কর্নেল সাহেবরা বলেছেন, এটা বড় 'অস্ত্র',
উম্মাহর খেদমত হবে! আল্লাহর নামে কাজ করি আমরা, বুঝিস না?”
একজন পুরোনো কর্মী কৌতুকের সুরে হাসতে
হাসতে বলেন, “আসলে আমাদের আল্লাহ একটাই, ভাই—টাকা। হালাল-হারাম সব এক। যত্ত টাকা, তত্ত
ধর্ম। আল্লাহ বড় রহস্যময়, কি বলেন?”
শাহাবুদ্দিন মৃদু হাসিতে সম্মতি জানান,
চোখে জ্বলে ওঠে বিদ্রূপ আর আত্মবিশ্বাসের আলো। তিনি বলেন, “ঠিক বলেছিস। এই দুনিয়ায়
টাকা-পয়সাই একমাত্র সত্য। বিএসএফ, বিজিবি—সব আল্লাহ্র নামে ঘুষ খায়। ওদের চোখে ইসলামও
টাকা, হিন্দুও টাকা। আমরা জানি, একটাই সত্য—এই লাইনে থাকলে টাকা-পয়সার অভাব নাই। আজকে
এই বাক্স আমাদের স্বপ্নকে আরেকটু বড় করে তুলবে, ইনশাআল্লাহ!”
রাতের অন্ধকারে বাক্সটি আবার ট্রাকে ওঠে।
চারপাশে শুধু নিরবতা, পদ্মার জলে ঢেউয়ের মৃদু শব্দ, আর মানুষের অন্তরে টাকার লোভ ও
ক্ষমতার আগুন। কেউ জানে না, এই রাতের শেষ কোথায়।
উম্মাহর স্বপ্ন?
শাহাবুদ্দিন একা ঘুরে এসে একটি সিগারেট
ধরালেন—ঠোঁটে খটখটে শুষ্কতা, চোখে ক্লান্তির ভার। তাঁর অন্তরের গভীরে আজ ভারী বিষণ্ণতা।
এক দিক থেকে তাঁর বিশ্বাসের কণ্ঠ ফিসফিসিয়ে বলে, "এসব হালাল নয়, এসব হারাম।"
কিন্তু বাস্তবতার নির্মম হাত তাঁকে অন্য দিকে টেনে নিয়ে যায়। তিনি অস্ফুটে ভাবেন,
“এই এমএলএ বারবার বলে, আমরা ইসলামের জন্য লড়ছি। কিন্তু আসলে? আমাদের হাতে অন্যায়ের
কালো দাগ লেগে যাচ্ছে। টাকার নেশায় ডুবে যাচ্ছি—আসলে দিনশেষে দাঙ্গা, পাচার, লুটপাটে
দাগ পড়ে আমাদের ধর্মের নামেই।”
কিছুটা দূরে শাগরেদরা নিচুস্বরে বলাবলি
করছে: “আমাদের আশেপাশের হিন্দু পাড়াগুলো এখন শান্ত। কিন্তু ওস্তাদ আদেশ দিলেই আগুন
জ্বলে উঠবে। নির্বাচন আসছে না?”
আরেকজনের গলায় চাপা আক্ষেপ, “তখন দোষ
আমাদের ঘাড়ে চাপবে। দলের এমএলএ দাদা সহজেই বলে দেবেন, 'বাইরের উগ্রপন্থীরা' এসব করেছে।
নাটক চলতেই থাকবে।”
শাহাবুদ্দিন বুকের ভেতরে গভীর দীর্ঘশ্বাস
অনুভব করেন। তাঁর হৃদয়ের এক অংশ চিৎকার করে, “এসব ঠিক নয়, একদিন আল্লাহর সামনে দাঁড়াতে
হবে।” অন্যদিকে বাস্তবতার চাপ, পেশার বাঁধন, ক্ষমতার লোভ—তাকে ফিরতে দেয় না।
"ইসলামের জন্য লড়াই"—এ কথায়
মাঝে মাঝে তাঁর হৃদয়ে এক অদ্ভুত ঝাঁকুনি লাগে। “মুসলিম উম্মাহর জন্য কিছু করছি”—এসব
স্লোগান শুনলে চোখে জল আসে তাঁর। কিন্তু মন গভীরে প্রশ্ন তোলে, “এসব কি সত্যিকারের
জিহাদ? নাকি শুধুই ক্ষমতা আর টাকার নোংরা খেলায় ধর্মের নাম ব্যবহার করছি?”
সিগারেটের ধোঁয়ায় আকাশের তারা ম্লান
দেখায়। শাহাবুদ্দিনের মনে হয়, আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো উত্তর নেই। তাঁর অন্তরের গভীরে
এই দ্বন্দ্ব অন্ধকারের মতোই ক্রমশ ঘন হয়ে উঠছে।
ট্রেনপথে গৌহাটি
একদিন পর ভোরের রহস্যময় আলোয় হঠাৎ শহরে
ফিসফিসানি ছড়াল—শাহাবুদ্দিনের লোকেরা মাল গাড়ি নয়, ট্রেনে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কারণ রাস্তায় পুলিশের সন্দেহজনক চেকপোস্ট বেশি, আর ট্রেনের যাত্রাপথে মালদা-রামপুরহাট-জলপাইগুড়ি
হয়ে অসমে ঢোকা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। পুলিশকে যথেষ্ট ঘুষ বা উপযুক্ত পরিচয় দিয়েই সহজে
পথ পেরিয়ে যাওয়া যাবে।
শাহাবুদ্দিনের চোখে বিজয়ের আলো ঝলসে
ওঠে, তিনি হাসিমুখে বলেন, “ট্রেনে কাস্টমসের স্ক্যান নেই বললেই চলে। বড় হলে সমস্যা,
কিন্তু এই স্রেফ ২৫ কেজির একটি সুটকেস—ব্যাগের মতো। আল্লাহ্ চাইলে সামলে নেব ইনশাআল্লাহ।”
একটি রহস্যময় হাসি দিয়ে শাহাবুদ্দিন
আহমেদের হাতে গুঁজে দেন কিছু টাকা। আহমেদের চোখে উজ্জ্বলতা, শাহাবুদ্দিন বলেন, “আহমেদ,
রাস্তার রেল পুলিশের ইন্সপেক্টর তোমাকে চেনে। একটু ‘উপহার’ দিলে পথ পরিষ্কার থাকবে,
ঠিক আছে?” আহমেদের মুখে দৃঢ় অথচ শান্ত উত্তর, “ইনশাআল্লাহ ভাই, সব সামলে নেব।"
রাতের অন্ধকারে মুর্শিদাবাদের নির্জন
স্টেশনে থেমে থাকা “গৌহাটি-লিংক এক্সপ্রেস” ট্রেন যেন রহস্যময় ভাগ্যের যাত্রার প্রস্তুতি
নিচ্ছে। স্টেশনের আবছা আলোর নিচে দাঁড়িয়ে জাকির, মালেক আর সালেহ। তাদের চোখে উত্তেজনা
ও শঙ্কার মিশ্রণ।
শেষ মুহূর্তে শাহাবুদ্দিন নীচু গলায়
তাদের বোঝান, “ভাইসব, তোমরা কওমের কাজ করছো, উম্মাহর স্বার্থ। ভারতের মুসলিমরা আজ চাপের
মধ্যে। এই মালটি নিরাপদে পৌঁছালেই বড় অ্যাকশন হবে। ইনশাআল্লাহ, সবাই জেগে উঠবে।” তাঁর
গলার রহস্যময় গভীরতা ওদের হৃদয়ে কাঁপন ধরায়।
ট্রেনে ওঠার আগে জাকির অস্ফুটে বলে,
“বিসমিল্লাহ, আল্লাহ্ আমাদের সহায় হোন।” মালেকের কণ্ঠে দ্বিধার ছায়া, “আমরা কি কবিরা
গুনাহ করছি না? সাধারণ মানুষ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়?” সালেহের কণ্ঠে ক্ষোভ ও বিশ্বাসের
অদ্ভুত মিশেল, “চুপ কর, ইসলামের কাজ বলে কথা! এটাই জিহাদের অংশ—না হলে সারাজীবন আমরা
অপমানিত থাকব।"
মালেক চুপ করে থাকে, দ্বিধা ও বিশ্বাসের
দোলাচল হৃদয়ে নিয়ে। ট্রেনের ঘোষণা আসে, যাত্রা শুরু হতে চলেছে। ওরা রহস্যময় সুটকেসটি
নিয়ে স্লিপার কামরায় উঠে যায়—লোকজন ঘুমিয়ে, রেল পুলিশের হাতে আগেই চলে গেছে 'উপহার'।
ট্রেনের চাকায় যেন রহস্যের ঘূর্ণি, পরমাণু উপাদানের হালকা গন্ধ শুঁকতে পারে না ডগ-স্কোয়াডের
কুকুরগুলো। ট্রেন ছুটে চলে রাতের বুকে, সামনে অপেক্ষা করছে এক অজানা অধ্যায়।
ট্রেনে বেশ কয়েকঘণ্টা চলে। সন্ধ্যা নাগাদ
জলপাইগুড়ি স্টেশনে থামে। এখানে আরেকজন লোক—মুনির—ঠিক করে রেখেছে, ওদের সুটকেস নামিয়ে
দেবে অন্য প্ল্যাটফর্মে। বেশ খানিক স্নায়ুচাপ ও উত্তেজনা—কোনো গণ্ডগোল হবে না তো?
স্টেশন ভিড়ে ঠাসা। হিন্দু, মুসলিম সব
যাত্রী মিলেমিশে আসছে-যাচ্ছে, কেউ কেউ উৎসবের কেনাকাটা নিয়ে ফিরছে, কারো ফেসবুকে লাইভ
স্ট্যাটাস… কেউ কল্পনাও করে না, এই সুটকেসে পারমাণবিক বিনাশ লুকানো।
একটু পর লোকাল পুলিশের দুজন কনস্টেবল
ঘুরে বেড়াচ্ছে। জাকির-মালেকদের হৃৎপিণ্ড ধক করে ওঠে। কিন্তু মুনির ইশারায় বুঝিয়ে
দেয়, “সব সেট করা আছে, ভয় নেই।” সত্যি, পুলিশ কাছে এসেও আর সন্দেহ করে না—গরিব চেহারার
ছেলেগুলো, বাঁধানো সুটকেস দেখলে কি আর কি?
বেদনাময় স্মৃতি
ট্রেনের জানালার পাশের সিটে বসে সালেহ
নিজের ফোন স্ক্রল করছে—মনের ভেতর এক গভীর অস্থিরতা আর ক্ষোভ। খবরের শিরোনামে তাঁর চোখ
আটকে যায়, "হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় দোকান পুড়ে ছাই, বহু মুসলমান নিহত।"
আরেকটি খবরে, "গরু বিক্রির অভিযোগে মুসলমান ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা।" প্রতিটি
লাইন যেন তাঁর রক্তে আগুন ধরিয়ে দেয়। সালেহের ভেতরের দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ
আর অভিমান যেন আজ ভাষা খুঁজে পায়।
নিজের মনেই সে ফুঁসে ওঠে, "দেখো,
আমাদের সাথে কী আচরণ করছে এরা! আমাদের নাম শুনলেই সন্দেহের চোখে তাকায়। বাড়ির পাশের
মসজিদ থেকে আজান দিলে বিরক্ত হয়। ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি—‘আমরা অন্যদের থেকে আলাদা’,
‘আমাদের ওপর অত্যাচার হচ্ছে’, ‘মুসলমানদের জায়গা নেই এ দেশে।’ এগুলোই তো আমাদের শেখানো
হয়েছে। স্কুলে, পাড়ায়, মসজিদে—সবখানে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়, আমরা ‘বিপন্ন’।
ছোট্ট থেকেই শুনছি, মুসলিম হওয়া যেন এক বিরাট পাপ—যেন সব দোষ আমাদের!"
তাঁর মনের মধ্যে আজ অজস্র মুখ ভেসে ওঠে—পাড়ার
মসজিদের ইমাম সাহেবের কঠিন ভাষণ, বন্ধু-বান্ধবদের ক্রোধময় বক্তব্য, নেতা-নেত্রীদের
রাজনৈতিক সভার উত্তেজনাপূর্ণ কথাবার্তা। এসব কথার নিচে চাপা পড়ে থাকে প্রতিবেশী মানিকের
মুখ, যে কখনও তাঁর অসুস্থ বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে; অথবা দোকানি সুবল চাচার হাসি
মুখ, যে সবসময় তাদের বাড়িতে সময়মতো চাল-ডাল পৌঁছে দেয়। কিন্তু সালেহ আজ কিছুই দেখতে
পায় না—অদৃশ্য এক প্রচারের বিষ তাঁর চোখে কালো পর্দা টেনে দিয়েছে।
সে নিজের মনেই ভাবে, “মানুষ হিসেবে হয়তো
এরা ভালো, কিন্তু এরা তো হিন্দু! আমাদের ধর্ম আলাদা, সংস্কৃতি আলাদা। আর সেই আলাদাতেই
তো আমাদের সব দুর্দশার কারণ। বারবার বলে দেওয়া হয়েছে, 'ওরা তোমাদের শত্রু, ওদের ওপর
বিশ্বাস রাখা যাবে না।' আমাদের দুর্বলতা, নির্যাতনের কাহিনী বারবার শুনতে শুনতে আজ
আমরা সত্যিই নিজেদের অসহায় ভাবতে শুরু করেছি।"
নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব আর বিরক্তি নিয়ে
সালেহ জানালার বাইরে তাকায়। চলন্ত ট্রেনের অন্ধকারে দৃশ্যগুলো পিছিয়ে যেতে থাকে।
সে বিড়বিড় করে বলে, "শাহাবুদ্দিন ভাই বলেছেন, উম্মাহর স্বার্থে আমাদের এটা করতে
হবে। আমাদের দুর্দশা, আমাদের লড়াই—এসব কিছু আল্লাহর নামে হচ্ছে। আমরা কী আর করতে পারি,
আমাদের ভাগ্যেই তো লেখা আছে এই লড়াই।"
তাঁর বুকের ভেতরের প্রশ্নগুলো উত্তর পায়
না, বরং তা গভীর অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ট্রেন ছুটে চলে, তাঁর মনেও চলতে থাকে এক অন্ধকার,
বিভ্রান্তিকর যাত্রা—যার গন্তব্য অজানা।
গৌহাটি
জলপাইগুড়ি থেকে গৌহাটি এক্সপ্রেস ট্রেনে
রাতের নির্জনতায় বিভ্রান্তির পথ শুরু হয়। পুলিশের কড়া তল্লাশি আর এনআইএ-র নজর এড়াতে
ওরা সাধারণ পোশাক পরে, ব্যাগের মাঝখানে গোপনে লুকিয়ে রাখে রহস্যময় সুটকেসটি। ট্রেনের
আলো-আঁধারিতে মুখোমুখি বসে সাধারণ হিন্দু-মুসলিম যাত্রীরা—কেউ ওষুধ খাচ্ছে, কেউ আবার
খাবার ভাগাভাগি করছে। যেন ধর্মের ভিন্নতা তাদের স্পর্শ করতে পারেনি, যেন সবাই মিলে
এক পরিবার, এক অদৃশ্য বন্ধনে আবদ্ধ।
এই দৃশ্য দেখে মালেকের বুকের ভেতরে গভীর
এক দীর্ঘশ্বাস ওঠে। সে পকেট থেকে তসবি বের করে অজান্তেই অস্ফুটে জপ করতে থাকে, “আল্লাহ্,
তুমি তো আমাদের অভিভাবক, আমাদের রক্ষা করো। কিন্তু এ কাজ কি সত্যিই তোমার পথে? এই নিরীহ
মানুষগুলোকে দেখে আমার হৃদয় কাঁপে। হিন্দু-মুসলমান বলে কি কিছু আলাদা আছে এই ট্রেনে?
তোমার কাছে কি আমরা সত্যিই সঠিক কাজ করছি?”
তার পাশে বসা জাকির হাসিমুখে, কিন্তু
চোখের গভীরে অস্থিরতার ঝিলিক। সে বলে, “মালেক, ভয়ের কিছু নেই। আমরা ঠিক পথেই আছি,
ঠিক?” জাকিরের কথায় বিশ্বাসের চেয়ে বেশি প্রশ্ন লুকিয়ে থাকে।
সালেহ চাপা স্বরে উত্তর দেয়, “ইনশাআল্লাহ,
কল্যাণ হবে। আমাদের তো বলা হয়েছে, উম্মাহর স্বার্থে এটা প্রয়োজন। কিন্তু এই লোকগুলোকে
দেখে… আমারও তো বুক কেঁপে ওঠে। এরা তো আমাদের মতোই সাধারণ মানুষ, সাধারণ যাত্রী। এদের
কোনো দোষ নেই, তবু আমরা কি আসলে নির্দোষদের বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছি?”
কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর জাকির অস্ফুটে
বলে ওঠে, “কিন্তু ভাই, শাহাবুদ্দিন ভাই আর এমএলএ সাহেব বলেছেন, আমরা নিপীড়িত। আমাদের
লড়াই করতে হবে। কিন্তু এই মানুষগুলোকে দেখে আমার কেবলই মনে হয়—এদের প্রতি আমাদের
ঘৃণা থাকার তো কোনো কারণ নেই!”
সালেহ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “আমরা
আসলে একটা বড় খেলার ছোট পুতুল। এই ট্রেনের মতোই আমাদের জীবন ছুটে চলছে অন্ধকারে—কোথায়
গন্তব্য, কোথায় শেষ, কেউ জানে না। কিন্তু এই অপরাধবোধ আর দ্বিধা থেকে মুক্তি পাব কীভাবে?”
ট্রেনের চাকাগুলো একঘেয়ে শব্দে বলে চলে,
যেন তাদের প্রশ্নের উত্তর কোথাও নেই। চারপাশে শুধু নীরবতা, শুধুই রাতের রহস্য।
সেফ হাউস
অবশেষে বহু নাটকীয়তার পর তারা গুয়াহাটির
শহরতলিতে পৌঁছায়। নির্জন এক ফার্মহাউস, ডা. মনসুরের বাড়ি—এই বাড়ি বহু গোপন অভিযানের
সাক্ষী। বাড়িটির দেয়ালে শ্যাওলা, চারপাশে ঘন জঙ্গলে অদ্ভুত নীরবতা, যেন প্রকৃতি নিজেই
এই ষড়যন্ত্রের সাক্ষী হতে প্রস্তুত।
সন্ধ্যার আঁধারে তারা সুটকেসটি সাবধানে
নামিয়ে ঘরের পেছনে একটি গোপন কক্ষে তালাবদ্ধ করে রাখে। ডা. মনসুর সতর্ক চোখে নির্দেশ
দেন, “কাল বিশেষজ্ঞ আসবেন, বাক্স খুলে পরবর্তী ধাপ বুঝিয়ে দেবেন। আজ বিশ্রাম নাও তোমরা।”
ঘরের ভেতরে সালেহ ক্লান্ত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“আলহামদুলিল্লাহ, ভাইসব। আল্লাহ্র রহমতে মাল পৌঁছে দিলাম।” জাকির মুখে চাপা উদ্বেগ
নিয়ে উত্তর দেয়, “ইনশাআল্লাহ, আমাদের কাজ শেষ। এখন বাকিটা আল্লাহ্র হাতে।”
মালেক ভেতরের দ্বিধা ও ভয়ের দমবন্ধ করা অনুভূতি নিয়ে
ফিসফিস করে বলে, “ইয়া আল্লাহ, এই বাক্সে যদি এমন কিছু থাকে যা নির্দোষ মানুষের ক্ষতি
করে, তবে কি আমরা গুনাহ্গার হব না?”
সালেহ দৃঢ় স্বরে কুরআনের একটি আয়াত
স্মরণ করিয়ে দেয়, “আল্লাহ বলেছেন—‘ইন্নাল্লাহা মা'আস সাবিরীন’—আল্লাহ ধৈর্যশীলদের
সাথে আছেন। আমাদের কাজ ধৈর্য্য ধরে উম্মাহর জন্য চেষ্টা করা।”
জাকির যেন নিজেকেই বোঝানোর চেষ্টা করে,
“আমরা তো জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি। ভারতের মুসলমানদের ওপর যে অবিচার হচ্ছে, তা
তো আর সহ্য করা যায় না।”
মালেকের চোখে পানি চলে আসে, সে বলে,
“কিন্তু ইসলাম তো নিরীহের ক্ষতি করতে নিষেধ করে। আমাদের ভেতরের এই দ্বিধা কি ঈমানের
দুর্বলতা, না আল্লাহ্র পক্ষ থেকে হিদায়াত?”
সালেহ কাঁধে হাত রেখে আশ্বস্ত করে, “আমাদের
মনে রাখতেই হবে, আমরা আল্লাহর বান্দা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘মুসলমান মুসলমানের
জন্য একটি দেহের মতো, এক অংশ ব্যথা পেলে পুরো দেহই ব্যথা পায়।’ আমাদের উম্মাহ্ আজ
আহত, আমরা সেই ব্যথার প্রতিকার করতে চাইছি মাত্র।"
তারা চুপ করে যায়, ঘরে নেমে আসে ভারী
নিস্তব্ধতা। বাহিরে কুয়াশার আস্তরণ যেন গাঢ় হতে থাকে। রাতের নিস্তব্ধতায়, দূর থেকে
ভেসে আসা শেয়ালের কান্নার সঙ্গে মিশে যায় তাদের বুকের ভেতরের চাপা আর্তনাদ। গভীর
অন্ধকারে, যেন ওই সুটকেসটি বুকে চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলছে—অপেক্ষা করছে কোন এক অজানা পরিণতির।
চতুর্থ অধ্যাথঃ
চক্রান্ত্র পর্ব
গভীর রাতের ছায়া
ঢাকার
ক্যান্টনমেন্টের পুরনো ভবনটির করিডোর আজ যেন রহস্যের দীর্ঘ, অন্ধকার টানেল। দেয়ালের
স্যাঁতসেঁতে দাগ আর সিলিং থেকে ঝুলে থাকা ফানুসগুলো যেন ইতিহাসের সাক্ষী—একটি ইতিহাস
যা লেখা হয় ক্ষমতার কালিতে, মানবিক অনুভূতির কোনো জায়গা সেখানে নেই। একটি গোপন কক্ষে
নিভৃত আলোয় বসেছেন কর্নেল ফারুক, ব্রিগেডিয়ার সোহেল এবং মেজর ওয়াসিম। টেবিলের ওপর
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানচিত্র স্পষ্টভাবে ছড়িয়ে আছে—আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম,
নাগাল্যান্ড, মেঘালয় এবং অরুণাচল। পাশে গুয়াহাটির বিশেষ বিশদ নকশা।
এই গোপন
আলোচনায় অংশ নিয়েছেন আরও দুজন: মেজর আরিফ (ছদ্মনাম)—পাকিস্তানি গোয়েন্দা আইএসআই-এর
কর্মকর্তা, তাঁর কণ্ঠে প্রচ্ছন্ন অহংকার এবং নির্মম শীতলতা। মিঃ হাও—চীনের গোয়েন্দা
সংস্থা এমএসএস-এর দূত, মুখে রহস্যময় হাসি, চোখে লুকানো নিষ্ঠুর বুদ্ধিমত্তা।
তাদের
চোখে কোনো দ্বিধা নেই, বরং ক্ষমতার নগ্ন লোভ। কর্নেল ফারুক শান্ত, নিষ্ঠুর কণ্ঠে শুরু
করলেন, “আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে পারমাণবিক ডিভাইসটি সঠিক জায়গায় স্থাপন করা হয়েছে।
গুয়াহাটির সেক্রেটারিয়েটে, যেখানে মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা থাকবেন, সেই ভবনটিই
আদর্শ টার্গেট। হামলা হবে যথেষ্ট বড়, বিধ্বংসী—যাতে ভারত চিরদিনের জন্য কেঁপে ওঠে।"
মেজর
আরিফ নিষ্ঠুর শীতল হাসি হেসে উর্দু উচ্চারণে বলেন, “হিমন্ত স্রেফ আসাম কা নেতা নেহি,
পুরে হিন্দুস্তান কি হিন্দুত্ববাদ কা চেহরা হ্যায়। উসে খতম করনে সে হিন্দুত্ববাদিয়োঁ
কি কামার টুট জায়েগি, অউর পুরো হিন্দুস্তান মে সিয়াসি বুহরান পায়দা হো জায়েগা। ইয়ে
হামারে উম্মাহ্ কে লিয়ে এক আযীম ফুরসত হ্যায়।"
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল ঠোঁটে অল্প হাসি এনে যোগ করেন, “হিমন্ত বিশ্বশর্মার মৃত্যু হলে দিল্লির প্রশাসন
আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। ওরা বুঝবে, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ওদের নিয়ন্ত্রণ নড়বড়ে। বিচ্ছিন্নতাবাদী
গোষ্ঠীগুলো মাথাচাড়া দেবে। আমরা শুধু আগুনটা জ্বালিয়ে দেব, বাকিটা নিজেরাই ছড়িয়ে
পড়বে।"
মিঃ
হাও সতর্ক কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “এই হামলায় ভারতের সন্দেহ প্রথমে পড়বে পাকিস্তান
ও বাংলাদেশের ওপর। আমাদের লক্ষ্য, ভারত যেন সামরিক পদক্ষেপ নেয়। এতে আমরা আন্তর্জাতিকভাবে
হস্তক্ষেপ করতে পারব। আপনাদের প্রস্তুতি থাকতে হবে পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য।"
কর্নেল
ফারুকের মুখে তখনও মানবিক চিন্তার চিহ্ন নেই। তিনি শান্ত, ঠাণ্ডা গলায় বলেন, “ঠিক
এটাই আমরা চাই। ইউনূস সরকার এখন দুর্বল। ভারত চাপ দিলে বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে।
তখন আমাদের জন্য রক্ষকের ভূমিকায় ক্ষমতা নেওয়া সহজ হবে। এই সুযোগ আমাদের হাতছাড়া
হতে পারে না।"
তারা
সবাই নিশ্চুপ হয়ে যায়, ঘরের বাতাস যেন আরও ভারী হয়ে ওঠে। এই কক্ষে মানবিকতা বা করুণার
ঠাঁই নেই, শুধু ক্ষমতা, ষড়যন্ত্র আর হিংস্র উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক নিঃসঙ্গ সাম্রাজ্য।
বিস্ফোরণের প্রযুক্তি
নকশার
ওপর ঝুঁকে পড়ে মেজর ওয়াসিম গভীর, স্থির কণ্ঠে ব্যাখ্যা শুরু করলেন, “আমাদের হাতে
থাকা সুটকেস-আকৃতির পারমাণবিক ডিভাইসটি প্রায় ১-২ কিলোটন TNT সমতুল্যের শক্তি উৎপাদনে
সক্ষম। সেক্রেটারিয়েট ভবনটিকে কার্যকরভাবে ধ্বংস করার জন্য ডিভাইসটি ১০০ মিটারের মধ্যে
বিস্ফোরণ ঘটালেই যথেষ্ট। এই দূরত্বে বিস্ফোরণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ভবনটির মূল কাঠামো
ধসে পড়বে, রেডিয়েশন দ্রুত চারপাশে ছড়িয়ে পড়বে এবং জনমনে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করবে।”
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল কণ্ঠে ঠাণ্ডা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বললেন, “আসামে সম্প্রতি নিরাপত্তা ব্যবস্থায়
উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা হয়েছে। কিন্তু আমরা কোনো নিরাপত্তা বলয়ের খুব কাছে যাব না।
আমাদের বেছে নেওয়া স্থান হচ্ছে সেক্রেটারিয়েটের কাছাকাছি একটি জনবহুল পাবলিক কার
পার্কিং, ভবন থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ মিটার দূরে। একটি ছোট গাড়ির ভেতর ডিভাইস রেখে
দিলে সিকিউরিটি সহজেই এড়ানো যাবে। আমরা একটি মোবাইল বা সিম-কার্ড বেসড রিমোট ডিটোনেটর
ব্যবহার করব, যার সাহায্যে ৫০ কিলোমিটার দূর থেকেও বিস্ফোরণ ঘটানো যাবে।"
মেজর আরিফ আগ্রহ
ও কিছুটা সংশয় নিয়ে জানতে চাইলেন, “এই সিম-কার্ড ডিটোনেটরের প্রযুক্তি আসলে কীভাবে
কাজ করে?”
ওয়াসিম
বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন, “আমাদের ইলেকট্রনিক্স এক্সপার্টরা ডিভাইসের ভেতরে সার্কিট
পূর্বেই সেট-আপ করে রাখবে। নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করলে চারবার রিং হওয়ার পর, অভ্যন্তরীণ
রিলে অ্যাক্টিভ হয়ে যাবে। এরপর বিস্ফোরক চার্জের মাধ্যমে প্লুটোনিয়াম কোরটি দ্রুত
সংকুচিত হয়ে ক্রিটিকাল মাসে পৌঁছে যাবে। মুহূর্তের মধ্যেই নিউক্লিয়ার ফিশনের চেইন
রিঅ্যাকশন শুরু হবে এবং বিধ্বংসী বিস্ফোরণ ঘটবে।”
মিঃ
হাও পেন হাতে দ্রুত নোট নিতে নিতে সতর্ক করলেন, “বিস্ফোরণের সঠিক সময়, সঠিক অবস্থান
এবং সঠিক ফ্রিকোয়েন্সির সিগনাল নিশ্চিত করতে হবে। সামান্যতম ভুলেও ডিভাইস অকেজো বা
অকাল বিস্ফোরণের সম্ভাবনা রয়েছে।”
টেবিলের
ওপর মানচিত্রে স্পষ্ট দেখা গেল—সেক্রেটারিয়েট থেকে ৮৫ মিটার দূরে একটি খোলা পার্কিং
লট। এখানে প্রতিদিন শত শত গাড়ি রাখা হয়—সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি সাধারণ দর্শনার্থীরাও
এই পার্কিং ব্যবহার করেন। এই পার্কিং এলাকাটি কোনো সন্দেহ ছাড়াই সহজেই টার্গেট করা
সম্ভব।
কর্নেল
ফারুক মানচিত্রে নির্দিষ্ট একটি পয়েন্ট চিহ্নিত করে বলেন, “এই পার্কিং স্পটটাই বিস্ফোরণের
জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। সকাল দশটা নাগাদ গাড়ি পার্ক করা হবে, দুপুর নাগাদ মুখ্যমন্ত্রী
হিমন্ত বিশ্বশর্মাসহ অন্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা সেক্রেটারিয়েটে আসবেন। ঠিক তখনই
দূর থেকে ডিটোনেশন ট্রিগার করব।"
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল চোখে নিষ্ঠুর আনন্দ নিয়ে বলে ওঠেন, “এক মুহূর্তে পুরো সেক্রেটারিয়েট ধ্বংসস্তূপে
পরিণত হবে। মুখ্যমন্ত্রী ও শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মৃত্যু ঘটবে। এই ট্রমা ভারত
সরকারের পক্ষে সামাল দেওয়া কঠিন হবে। এটি রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিকভাবে এক বড় আঘাত
হবে।"
কর্নেল
ফারুক স্বল্প বিরতি নিয়ে বলেন, “গুয়াহাটিতে আমাদের স্লিপার সেল—সফিক, জসীম ও মনসুর
ইতোমধ্যে সেফ হাউসে ‘ব্রিফকেস’ স্থাপন করেছে। তারা এখন একটি স্টেশন-ওয়াগন বা ছোট গাড়ি
ভাড়া করবে, ভুয়া নম্বর প্লেট লাগিয়ে পার্কিংয়ে রেখে আসবে। তাদেরকে যথেষ্ট অর্থ
ও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।"
মেজর আরিফ গম্ভীর
গলায় জিজ্ঞেস করলেন, “সফিকরা কি জানে এটা আসলে পারমাণবিক ডিভাইস?”
কর্নেল
ফারুক হিমশীতল হাসি হেসে উত্তর দিলেন, “না, তারা জানে না। তাদের বলা হয়েছে এটি একটি
শক্তিশালী বিস্ফোরক। তারা শুধু টাকা আর উম্মাহর স্বার্থের কথা ভেবে কাজ করছে। আমরা
নিশ্চিত, তারা কখনো সত্যটা জানতে পারবে না—যতক্ষণ না বিস্ফোরণ হয়ে যায়।”
রাজনৈতিক
আলোচনার
ঘরে নীরবতার গভীরে লুকানো এক অদ্ভুত শান্তি—কেমন যেন পরাবাস্তব, যেন অন্ধকারের ভেতরে
মৃদু হাসছে ক্ষমতার নিষ্ঠুর মুখগুলো। মেজর আরিফের ঠোঁটে নির্লিপ্ততার হাসি, চোখের গভীরে
শীতল আত্মবিশ্বাস, তিনি ঠাণ্ডা গলায় উর্দু উচ্চারণে বলতে লাগলেন, “পাকিস্তান কি তরফ
সে হাম চাহতে হ্যায় কে হিন্দুস্তান কো এক অ্যায়সা ধাক্কা লাগে জো উনকে অন্দর সে হিলা
দে। কাশ্মীর মে মুসলমানো পে জুলম, ওয়াকফ সম্পত্তি জবত করনে কা বদলা জরুরি হ্যায়।
জব ভারত হামলা করেগা, হাম ইউনাইটেড নেশনস কি তরফ দেখে শানে ঝাড়কে কহেঙ্গে, ‘দেখিয়ে,
হামারা কোই হাত নেহি। ইয়ে তো স্রেফ দেহেশতগর্দো কি কারওয়াই হ্যায়।’ বাইনাল-আকোয়ামি
সিয়াসত কি থিয়েটার মে হামারা রোল পারফেক্ট রহেগা। বড়ে মুল্কো কি দখলন্দাজি হোগি,
ইনসানি হুকুক কি তাকরির হোগি— হামারি হেফাজত তব ইয়াকিনি হোগি।”
মিঃ
হাও তার কথায় মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। চোখে তাঁর এক ধূর্ত উজ্জ্বলতা, ঠোঁটে রহস্যময়
হাসি—“চীনও চায় ভারত ব্যস্ত হোক আঞ্চলিক সংকটে। ভারত লাদাখ বা অন্য সীমান্ত এলাকায়
ফোকাস করার সুযোগই পাবে না। দক্ষিণ এশিয়ার এই অদ্ভুত দাবার চালগুলো আমাদের পক্ষেও
লাভজনক। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের সামরিক শক্তি তখন আরও শক্তিশালী হবে। সেই সুযোগে আমরাও
আমাদের নীরব কূটনীতিতে এগিয়ে যাব।"
কর্নেল
ফারুকের কণ্ঠে গভীর আত্মপ্রত্যয়, যেন এই নৃশংস পরিকল্পনাটিই সবচেয়ে ন্যায্য, সবচেয়ে
যৌক্তিক। তাঁর মুখে মানবিকতার ছিটেফোঁটা নেই, বরং অদ্ভুত এক আনন্দের আভাস—“আমাদের এই
হামলা ইউনূস সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দেবে। ভারত যখন চাপ সৃষ্টি করবে, ইউনূস সরকারের পতন
ঘটবে। সেই সুযোগেই আমরা শক্ত হাতে ক্ষমতা দখল করব। ইতিহাস আমাদের দিকেই তাকিয়ে আছে,
ইনশাআল্লাহ।"
ঘরটি
তখন শীতল, ভারী এক নীরবতায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির নির্মম দাবার বোর্ডে
তাদের নীরব হাসি যেন দানবীয়, অথচ পরম প্রশান্ত। কোনো মানবিক বিবেক নেই, আছে শুধু ক্ষমতার
অন্ধ তৃষ্ণা, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মের মুখোশে ঢাকা চরম অমানবিকতা। ঘরের দেয়ালগুলো যেন
ফিসফিস করে বলে—এখানে ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো ঈশ্বর নেই।
কক্ষে
আলো-আঁধারির মাঝে হঠাৎ বাইরে बिजली
চমকায়, যদিও আকাশে মেঘ ছিল না। সবাই এক মুহূর্ত চোখ তুলে তাকায়—মনে হয় কোনো অলৌকিক
আলোকরেখা এসে দেয়ালে ছায়া ফেলছে। সেই ছায়ায় ভেসে ওঠে ভবিষ্যতের রক্তাক্ত ছবি—সেক্রেটারিয়েট
ধূলিসাৎ, আগুনে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ, মানুষের আর্তচিৎকার। কেউ বাস্তবে এটা দেখল
না, অথচ মনের গহীনে যেন ঝিলিক দিয়ে যায় অদৃশ্য কোনো দৈব দৃশ্য। তারপর স্বাভাবিক হয়ে
যায় পরিস্থিতি, আলো আবার আগের মতো নিস্তব্ধ।
মেজর
ওয়াসিম ফিসফিস করে বললেন, “আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমাদের কাজ সফল হবে। আর ভারতকে শিক্ষা
হবে—মুসলিমরা আর নিরব থাকবে না।” বাকিরা মাথা নাড়লেন, কেউ হয়তো আতঙ্কে, কেউ উল্লাসে।
সময়সূচি ও ডিটেলস
ব্রিগেডিয়ার সোহেল
তখন একটা নোটবুকে বিশদ সময়সূচি লেখেন:
- ডে-১:
গুয়াহাটি সেলের লোকজন গাড়ি ভাড়া করবে বা কিনবে। ফেইক কাগজপত্র ও নম্বর প্লেট
সংগ্রহ করা হবে।
- ডে-২: গাড়ির সিট ও ড্যাশবোর্ড খুলে
বোমা সেট করা হবে। সিম-কার্ড ট্রিগার ইনস্টল, শেষমেশ পরীক্ষাও হবে, যদিও খুব সতর্কতার
সঙ্গে।
- ডে-৩: মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতির দিন।
সকাল ১০টার মধ্যে গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে দেওয়া—এ সময় সিকিউরিটি গার্ড কিছু চেক
করলেও বোমা লুকানো থাকবে, আর পার্কিং-লটে শত শত গাড়ির ভিড়ে নজরদারি কঠিন।
- ডে-৩ (১২টা - ১টার
মধ্যে):
ভারী ব্যস্ত সময়, মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা সেক্রেটারিয়েটে;
কেউ প্রেস ব্রিফিং দেবে, কেউ মন্ত্রীসভার মিটিং… ঠিক ওই সময়ে সিম-কার্ডে কল করে
বিস্ফোরণ ঘটানো হবে।
- ডে-৩ (বিকেল):
ডিটোনেশনকারী ব্যক্তি কমপক্ষে ৫০ কিলোমিটার দূরে সরে যাবে—স্যান্ড কোয়ারিতে বা
কোনো পাহাড়ি এলাকায় গা ঢাকা দিয়ে এই কল দেবে। পুরোনো ফোন, প্রিপেইড সিম, সবই
বিলীন হয়ে যাবে পরে।
মেজর আরিফ খুশি সুরে
বলেন, “এ তো নিখুঁত প্ল্যান!”
মিঃ
হাও আবার সতর্ক করেছেন, “কিন্তু সতর্ক! একটু ফাঁস হলে ভারত গোয়েন্দা তৎপরতা বেড়ে
যাবে। আর বিস্ফোরণের পরে রেডিয়েশন ছড়াবে, ব্যাপক মানবিক ক্ষতি।”
কর্নেল
ফারুক গলা নামিয়ে বলেন, “আমরাও এটাই চাই—ভয়াবহ বার্তা। তাদের বোঝা উচিত, মুসলিমরা
বা বাংলাদেশ-পাকিস্তান কেউই আর মাথা নিচু করে থাকবে না।”
টেবিলের
ওপর কিছু ভিডিও ফুটেজ, স্যাটেলাইট ইমেজ পড়ে আছে—সেক্রেটারিয়েটের অফিস এলাকায় সারি
সারি গাড়ির সারাংশ দেখা যায়। সেখানে নিরাপত্তাকর্মী,
পিওন, ড্রাইভার এমন বহু সাধারণ মানুষ কাজ করে। বিস্ফোরণ মানেই এদের নিশ্চিত মৃত্যু।
কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে এটা কেবল “কল্যাটারাল ড্যামেজ।”
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল এ বিষয়ে একবারই বললেন, “যে কোনো বড় অ্যাটাকেই নিরীহ প্রাণহানি হয়। ওটা নিয়ে
আমরা ভাবতে পারি না।” বাকিরা নির্বিকার, চোখে শুধু আধিপত্য ও ক্ষমতার লালসা।
সামরিক উত্থান
সর্বশেষ
আলোচনায় হঠাৎ কর্নেল ফারুকের কণ্ঠে শীতল দৃঢ়তা স্পষ্ট হলো—“এই হামলার পর ইউনূস সরকার
ভারতের চাপ সইতে পারবে না। আমাদের জন্য সুযোগ তৈরি হবে। সরকার আতঙ্কে আমাদের ডেকে নেবে—তখনই
আমাদের কাজ শুরু।”
মেজর
ওয়াসিম ঠোঁটে বিজয়ের কৌতুক ফুটিয়ে বললেন, “ঠিক বলেছেন, স্যার। অস্থিরতা তৈরি হলেই
আমরা দৃশ্যপটে নামব। জনগণকে বলব—'দেখুন, আপনাদের রক্ষা করতে এসেছি।' দেশ ও জনগণের নামে
ক্ষমতা দখলের এটাই সেরা উপায়।"
মেজর
আরিফ ঠাণ্ডা, উর্দু মেশানো উচ্চারণে মন্তব্য করলেন, “সাহেবান, হামারে হাথ মে এক তাকতওয়ার
তাস হ্যায়। হামারে মুল্ক কা মুকাদ্দার আজ হামারি মুুঠ্ঠি মে হ্যায়। হিন্দুস্তান জিতনা
জোড় লাগায়ে, হাম কহেঙ্গে ‘আমরা নির্দোষ, আপনাদের শত্রু আমরাও!’ আন্তর্জাতিক দুনিয়া
হামারে পাস হোগি, ইনশাআল্লাহ।”
মিঃ
হাও মুখে রহস্যময় হাসি নিয়ে বললেন, “আমরাও প্রস্তুত। ভারত ব্যস্ত হলে চীনের পথ পরিষ্কার
হবে। দক্ষিণ এশিয়ায় এখন চালটা আমাদের পক্ষে।”
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল চোখে অদ্ভুত নেশার আলো নিয়ে যোগ করলেন, “এই হামলার ফলাফল হবে অভূতপূর্ব। ভারত
বিভ্রান্ত হবে—যুদ্ধ না আলোচনা? এই সুযোগ আমাদের ক্ষমতার পথ খুলে দেবে।”
ঘরের
বাতাস আরও ভারী হয়ে উঠল। দরজার ফাঁক দিয়ে এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকল, কাগজপত্র সামান্য
কেঁপে উঠল, যেন প্রকৃতি নিজেও শিউরে উঠছে এই পরিকল্পনার অন্ধকার ভবিষ্যৎ ভেবে। দেয়ালে
হঠাৎ টিকটিকির তীক্ষ্ণ ডাক—যেন অজানা এক সতর্কতা।
কর্নেল
ফারুক উঠে দাঁড়ালেন, তাঁর কণ্ঠে আদেশের তীক্ষ্ণতা—“এবার সময় এসেছে। গুয়াহাটি সেলে
বার্তা পাঠানো হোক—পার্কিংয়ে গাড়ি রাখা হবে সকাল দশটায়, দুপুর বারোটায় সিম-ট্রিগারে
বিস্ফোরণ ঘটানো হবে। মুখ্যমন্ত্রীসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সেদিনই আমরা নিশ্চিহ্ন
করব।”
মেজর আরিফ উত্তেজিত
স্বরে উঠে দাঁড়ালেন, “ইনশাআল্লাহ, হাম হিন্দুস্তান কো ইয়ে দিখা দেঙ্গে কে মুসলমান
খেলনে কি চিজ নেহি!”
মিঃ
হাও ধীরস্থিরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে হাসলেন, “চীন এখন আরও একধাপ এগিয়ে গেল।”
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল ও মেজর ওয়াসিম পরস্পরের দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে সম্মতি বিনিময় করলেন—তাঁদের
দৃষ্টিতে নির্দয় বিজয়ের আনন্দ।
কর্নেল
ফারুক দরজা দিয়ে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলেন। করিডোরে ম্লান আলোয় হঠাৎ দেখা গেল দেয়ালের
পাশে একটি বিমর্ষ ছায়া—অতীতের কোনও মৃত সৈনিকের আততায়ী আত্মা, যেন ১৯৭৫-এর সেই অভিশপ্ত
রাতের রক্তের চিহ্ন আজও অদৃশ্য হয়ে যায়নি। সত্যিই কেউ তা দেখে না, শুধু অনুভব করে
বাতাসের ভারী, রহস্যময় নিস্তব্ধতায়।
পঞ্চম অধ্যায়-
গাফিলতি পর্ব
দিল্লির গোয়েন্দা সদরদপ্তরে শীতল
সকাল
নয়া
দিল্লির লোদী রোডের কাছে অবস্থিত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (RAW) ও ‘আইবি’
(IB)-এর মিলিত সদরদপ্তরে শীতের সকাল যেন এক অদ্ভুত স্তব্ধতায় মোড়ানো। ঘরের ভেতরে
কেবল ল্যাপটপের মৃদু আওয়াজ, কাগজপত্র ও ফাইলপত্রে ডুবে থাকা অফিসারদের চোখে গভীর উদ্বেগের
ছাপ। বারবার বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসছে—উত্তর-পূর্ব ভারতে বড় কোনো হামলার পরিকল্পনা
চলছে, কিন্তু সেই খবরের সত্যতা বা নির্দিষ্ট প্রমাণের সন্ধান মিলছে না। খবরটা যেন ধোঁয়াশার
মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
মিটিং
টেবিলে এক সিনিয়র কর্মকর্তা উদ্বিগ্নভাবে বলে উঠলেন, “স্যার, ফিল্ড থেকে স্পষ্ট কোনও
তথ্য নেই। মাঠ পর্যায়ের এজেন্টরা নিশ্চিত করতে পারছে না। মিডিয়ায় আমরা কী বলব?”
আরেকজন বিরক্তিসূচক
ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “মিডিয়া! মিডিয়া করে লাভটা কী? আসল তদন্ত, বাস্তব তথ্য কোথায়?
সবাই মিডিয়া-শো করতে চাইছে—সত্যিকারের কাজ ভুলে যাচ্ছি!”
দুপুর
গড়াতেই প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে ডাকা হলো জরুরি বৈঠক। প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নিরাপত্তা
উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান, র' ও আইবির প্রধানগণ সবাই উপস্থিত।
প্রধানমন্ত্রী গম্ভীর
ও কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে শুরু করলেন, “ডোভালজি, হামারে পাস অ্যায়সা কোই ঠোস ইনপুট হ্যায়,
ইয়া সির্ফ রিউমার হ্যায়?”
ডোভাল
শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে উত্তর দিলেন, “স্যার, হামারে সোর্সেস বতা রহে হ্যায়, বাংলাদেশ
অউর পাকিস্তান সে মিলকে কুছ উগ্রবাদী সংগঠন বড় হামলা কি পরিকল্পনা কর রহে হ্যায়।
হো সকতা হ্যায় অ্যায়সা হামলা জিসমে পারমাণবিক অস্ত্র ভি শামিল হো।”
প্রধানমন্ত্রী
কিছুটা অধৈর্য হয়ে বললেন, “পারমাণবিক অস্ত্র? আপ সমঝতে হ্যায় ইয়ে শব্দ জনতা মে আতঙ্ক
ফেলা দেগা। হাম মিডিয়া কো ক্যায়সে জবাব দেঙ্গে?”
এক সিনিয়র
সেনা কর্মকর্তা বিনয়ের সঙ্গে যোগ করলেন, “স্যার, হামারে পাস অ্যায়সি নিশ্চিত ইনপুট
নেহি হ্যায়। ফিল্ড সে স্পষ্ট তথ্য বিনা, অ্যায়সি বাত মিডিয়া মে লেকে আনা জনগণ কো
বিভ্রান্ত অউর ভীত করতে সকতা হ্যায়।”
প্রধানমন্ত্রী
কঠিন চোখে তাকালেন, “দেখিয়ে, রাজনীতি এক আলগ চিজ হ্যায় অউর জাতীয় নিরাপত্তা এক আলগ।
হাম মিডিয়াকে এ বার্তা দেঙ্গে কে সরকার সতর্ক হ্যায়। হামারি তৎপরতা নজর আয়ে। ইসসে
রাজনৈতিক মজবুতি ভি মিলেগি।”
ডোভাল
নিম্নস্বরে পরামর্শ দিলেন, “স্যার, সেনা অউর পুলিশ কো সক্রিয় রাখনে কা নির্দেশ দে
সকতে হ্যায়। অউর মিডিয়া মে স্ট্রাইক-শো কা স্টেটমেন্ট দে সকতে হ্যায়।”
প্রধানমন্ত্রী
মৃদু হাসলেন, “চুনাও আ রহে হ্যায়। ‘দেশ কি শত্রু মুসলিম জঙ্গি হামলা কি ষড়যন্ত্র
কর রহে হ্যায়’—এ বার্তা হামারে পক্ষে উপযোগী হোগি। দেখিয়ে, জনতা কি মনোভাব বনানা
জরুরি হ্যায়।"
কিছু
অফিসার মনে মনে হতাশ হলেন—তারা জানেন, বাস্তব মাঠপর্যায়ে নজরদারি ও তদন্ত ছাড়া নিরাপত্তা
সুনিশ্চিত করা অসম্ভব। অথচ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মনোযোগ মিডিয়ার নাট্যমঞ্চের দিকে। তারা
বুঝতে পারছেন, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে, সত্য ও জনসমর্থনকে পুঁজি করে রাজনীতির এই নাটক
আরও বহু দূর এগোবে। গোয়েন্দা ও নিরাপত্তার কাজ যে বাস্তবেই দুর্বল হয়ে পড়ছে, সেটা
কেউ প্রকাশ্যে বলতে সাহস পাচ্ছেন না।
অফিসার ‘আতিফ খান’
পরদিন
ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের দীর্ঘ করিডোরে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছেন আতিফ খান। গোয়েন্দা সংস্থা
‘আইবি’-এর এই অভিজ্ঞ মুসলিম অফিসারের হাতে থাকা ভারী ফাইলটিতে যেন জমে আছে তাঁর বহুদিনের
গভীর উদ্বেগ আর নিরবচ্ছিন্ন একাকিত্ব। করিডোরের নিঃসঙ্গতার প্রতিধ্বনিতে যেন তাঁর নিজেরই
অব্যক্ত প্রশ্নগুলো ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে বারবার। সহকর্মীদের চোখের আড়াল করা সন্দেহ
তাঁর কাছে নতুন নয়, তবুও প্রতিবারই তা তাঁর হৃদয়ে নতুন ক্ষতের সৃষ্টি করে। আজকের
হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক বাস্তবতায়, আতিফের মতো অফিসারদের প্রতি বিশ্বাসের চেয়ে অবিশ্বাসের
ছায়াই বেশি ঘন হয়ে উঠেছে।
দীর্ঘদিন
ধরেই কলকাতা, মুর্শিদাবাদ ও গুয়াহাটি অঞ্চলের অবৈধ অনুপ্রবেশ, চোরাচালান এবং গোপন
নেটওয়ার্ক নিয়ে কাজ করছেন আতিফ। তাঁর তথ্যের উৎসগুলো গভীর ও অন্ধকার এক জগতের বাসিন্দা।
এই জগতের সঙ্গে তার যোগাযোগই দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মনে গভীর সন্দেহের জন্ম
দেয়। তারা গোপনে বলে, “ও মুসলিম; ও কি আসলেই এসব নেটওয়ার্ক সামলাতে পারবে? না ও নিজেই
কোনো অঘটন ডেকে আনবে?” আতিফ স্পষ্ট জানেন, সন্দেহটা তার কাজ নিয়ে নয়, বরং তাঁর পরিচয়
নিয়ে।
নিজেকে
বারবার বোঝান আতিফ, “আমি একজন ভারতীয়, আমার দেশের প্রতি দায়িত্ব সবচেয়ে আগে। আমার
ধর্ম নয়, আমার দেশপ্রেমই আমার আসল পরিচয়।” কিন্তু এই কথাগুলো যেন শুধু নিজেরই শোনা;
অন্য কারো কাছে পৌঁছায় না।
সম্প্রতি
আতিফের একটি সূত্র থেকে ভেসে এসেছে অন্ধকার, বিপজ্জনক খবর—কলকাতা থেকে গুয়াহাটির দিকে
বড় কোনো ধ্বংসযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে, সম্ভবত পারমাণবিক আঘাত। তাঁর বিস্তারিত রিপোর্ট
দিল্লির কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছালেও, ফিরে এসেছে অবজ্ঞার উত্তর: “আবার তোমার মুসলিম
সোর্সের কথা? এগুলো কি বাস্তব নাকি অতিরঞ্জিত কল্পনা, কে জানে!” এই শব্দগুলো তাঁর কাছে
তিক্ত বিষের মতো; তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টাকে অবিশ্বাস আর অবজ্ঞায় দূরে ঠেলে দেয়।
প্রতিদিন
রাতে ঘুমের আগে আতিফের মনে একই প্রশ্ন ওঠে—“আমার দেশপ্রেম, আমার আন্তরিকতা, এসব কেন
বারবার আমার ধর্মীয় পরিচয়ের কাছে হেরে যায়?” অন্ধকার রাত তার প্রশ্নের কোনো জবাব
দেয় না; দেয়ালের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনিত হয় শুধু নিরুত্তর এক শূন্যতা।
অন্যদিকে,
ক্ষমতার গোপন কক্ষে নিঃশব্দে চলছে ভয়াবহ এক ষড়যন্ত্র। নির্বাচনের প্রাক্কালে একটি
রাজনৈতিক গোষ্ঠী যেন উৎসাহের সঙ্গেই অপেক্ষা করছে এমন একটি হামলার জন্য। তারা জানে,
রক্তের বন্যা আর আতঙ্কের ছায়ায় মানুষের মন সহজেই প্রভাবিত করা যায়। ধর্মীয় বিভেদের
ছুরি দিয়ে ভোটারদের হৃদয় ছিন্নভিন্ন করার জন্য এই অন্ধকার পরিকল্পনার জাল বিছানো
হচ্ছে অত্যন্ত সচেতনভাবে। দলের প্রবীণ নেতারা গোপনে আলোচনা করেন, “এমন হামলা ঘটলে প্রমাণ
হবে মুসলিমরাই দেশের প্রধান শত্রু, হিন্দুত্ববাদ আরও শক্তিশালী হবে। আমাদের রাজনৈতিক
লক্ষ্য পূরণ হবে সহজেই।"
এই নির্মম
কৌশলের ছায়া গোয়েন্দা সংস্থার ওপরও পড়েছে। আতিফ বুঝতে পারেন, এখানে সত্যের নয়,
মিথ্যারই প্রাধান্য বেশি। কেউ কেউ বাস্তবেই চান হামলা হোক, মৃত্যু ও আতঙ্কে সমাজ বিষাক্ত
হোক, যাতে তারা আরও সহজে ক্ষমতার পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে পারেন। আতিফের বুকের
গভীরে পুঞ্জীভূত হয় তীব্র এক বিষণ্ণতা—তিনি জানেন না, তাঁর নীরব যুদ্ধের পরিণাম কী
হবে। তবুও তিনি লড়ে যাচ্ছেন, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে—নিজের অস্তিত্ব, নিজের বিশ্বাস
আর নিজের বিবেকের সঙ্গে।
নিরাপত্তার নামে ফাঁপা কার্যক্রম
সুতরাং
গোয়েন্দা দপ্তর ও প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ের মঞ্চ থেকে নিয়মিতই সরব হয়ে ওঠে নাটকীয়
প্রেস কনফারেন্স: “আমরা সতর্ক, সীমান্তে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, দেশ সুরক্ষিত!” “আসামে
কোনো ধরনের নাশকতা হলে কেউই রেহাই পাবে না।”
টিভি
চ্যানেলগুলোর জমকালো টকশোতে বিশেষজ্ঞদের মুখে ফুটে ওঠে রক্তাক্ত উল্লাস, “আরও একটি
সার্জিকাল স্ট্রাইক চাই!” কিংবা চিৎকার করে ওঠেন কোনো উগ্র নেতা, “মুসলিম জঙ্গিবাদের
শিকড় চিরতরে উপড়ে ফেলতে হবে!” অথচ বাস্তব মাঠপর্যায়ে তদন্ত বা গোয়েন্দা তৎপরতার
কোনো সুস্পষ্ট ছক চোখে পড়ে না। কেবলই শূন্য হুমকি, মিডিয়ার আলোয় উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতি।
কিছু
অভিজ্ঞ অফিসার নীরবে কষ্ট পান, বিরক্ত হন। তারা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন—চটকদার মিডিয়ার
নাটকের আড়ালে ভয়াবহ বাস্তবতার ছায়া ঘনিয়ে আসছে। কিন্তু উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে
তাঁদের হাত-পা বাঁধা, সত্যের থেকে রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক এখানে অনেক বেশি প্রাধান্য পায়।
এমন
অবস্থার মধ্যেও আতিফ একাই নীরবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি আবারো গোপনে যোগাযোগ স্থাপন
করেন তার পুরনো সূত্রের সঙ্গে—কলকাতার পার্ক সার্কাসের নির্জন এক গলিতে সন্ধ্যার আধো
আলোয় মুখোমুখি হন ‘রউফ’ নামের এক রহস্যময় ব্যক্তির। রউফ—মাফিয়া, জঙ্গি সংগঠন ও বিদেশি
স্লিপার সেলের মধ্যকার সংযোগ স্থাপনকারী এক ক্ষমতাধর ব্যক্তিত্ব।
রউফ
ধীর গলায়, সন্দেহ ও ভয় মেশানো চোখে আতিফকে বলেন, “ভাইসাব, কিছু একটা ঘটবে নিশ্চয়ই,
আসাম সাইডে বড় প্ল্যান। এতে কে মরবে, কে বাঁচবে—সেটা কারো বিবেচনায় নেই। ওরা প্রস্তুত।"
আতিফ
ব্যথিত গলায় বলেন, “রউফ, তুমি তো বুঝতে পারছ—এই ধরনের হামলায় সাধারণ মুসলমানরাই বেশি
ক্ষতিগ্রস্ত হবে। দেশটাও তো আমাদেরই। কেন নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল মারতে চাও? অন্তত
অ্যাকশনের দিনক্ষণটা আমাকে জানাও, যাতে আমি থামাতে পারি।”
রউফ
হেসে ফেলেন—একটা বিদ্রূপের হাসি। কণ্ঠে তীক্ষ্ণতা, “তুমি সরকারি লোক। তোমাকে কীভাবে
বিশ্বাস করি? তোমার মুসলমান পরিচয় এখানে তোমার ঢাল হবে না, বরং তোমাকে আরও সন্দেহের
চোখে দেখবে সবাই।"
আতিফ
কিছু বলেন না। তাঁর ভেতরে হাহাকার উঠে, গভীর অভিমানে তাঁর বুক ভারী হয়ে যায়। তারপরও
নীরবে ছোট্ট নোটবুকে সম্ভাব্য তারিখ আর অবস্থান লিখে নেন, জানেন এই তথ্য কেউ হয়তো
গ্রহণ করবে না, তবুও তিনি নীরব থাকতে পারেন না।
দিল্লিতে
ফিরে আতিফ বিস্তারিত রিপোর্ট জমা দেন। স্পষ্ট ভাষায় লিখেন, "সূত্র মারফত জানা
গেছে, গুয়াহাটিতে সরকারি স্থাপনায় খুব দ্রুত বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।"
কিন্তু ঊর্ধ্বতন অফিসারের কাছে এই রিপোর্ট যেন কেবলই এক নিস্তেজ কাগজ। তিনি উদাসীন
ভঙ্গিতে বলেন, “ঠিক আছে, পরে দেখা যাবে।” পাশ থেকে একজন হিন্দু কর্মকর্তা হালকা কণ্ঠে
বলে ওঠেন, “মুসলিম সোর্সের কথাগুলো এমনই হয়, প্রায়ই exaggerated। কিছু হলে ছোটোখাটো
IED হবে হয়তো, বড় কিছু নয়।”
আতিফ
মনোবেদনা নিয়ে সরে আসেন। চারপাশে চিৎকার করে চলছে মিডিয়া, "মুসলিম ষড়যন্ত্রের
বিরুদ্ধে সরকার কঠোর।" বাস্তব কাজ না করে, বাস্তব হুমকিকে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক
স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজে ঘৃণা ও আতঙ্ক ছড়ানোর নিরন্তর এই প্রচেষ্টা আতিফকে বিষণ্ণ
করে।
ক্ষমতার
অলিন্দে কারো কারো গোপন মনোভাব স্পষ্ট—ঘৃণা, ভয় ও সহিংসতার রাজনীতি ভোট বাড়াবে। আতিফ
নিরুপায়। একাকী এই বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, নিজের বিবেকের কাছে নিঃশব্দে প্রশ্ন
করে যান, "এই অসহায় সময়ে সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো কি আদৌ সম্ভব?" উত্তর আসে
না, শুধু গভীর শূন্যতা তাকে গ্রাস করে।
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তের শৈথিল্য
আসামের
মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা দিল্লি সফরে এসে আত্মবিশ্বাসে উজ্জ্বল মুখে ঘোষণা করলেন,
“ভারতের গোয়েন্দা এজেন্সি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ—কোনো জঙ্গি হামলা করার সাহস তাদের হবে না।
আমি প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ছি, আসুন, আমাদের সামনে দাঁড়ান!” তাঁর এই কথার মধ্যে
ছিল ক্ষমতার দৃঢ়তা, কিন্তু হয়তো কিছুটা ছিল অহংকারের অন্ধত্বও।
জাতীয়
নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল ব্যক্তিগতভাবে তাকে সতর্ক করলেন, গভীর উদ্বেগের সুরে,
“হিমন্তজি, আপনার ওপর কিন্তু সত্যিকারের হুমকি রয়েছে, আপনার আরও সাবধান হওয়া উচিত।”
কিন্তু হিমন্ত কেবল হেসে উড়িয়ে দিলেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, “আমার চারপাশে জেড
প্লাস সিকিউরিটি। সাধারণ আইইডি কিংবা বিস্ফোরণে আমার কিছুই হবে না। এত ভয়ের কিছু নেই।”
তার চোখে আত্মবিশ্বাসের দীপ্তি, কিন্তু গোপন এই আত্মবিশ্বাসের নেপথ্যে কোথাও হয়তো
ছিল এক অচেনা অজ্ঞতা। পারমাণবিক অস্ত্রের মতো কোনো ভয়াবহ হামলার সম্ভাবনা তিনি মনে
করলেন কল্পনার বাড়াবাড়ি—“এসব রাবিশ কথাবার্তা!” বলে তিনি ঝেড়ে ফেললেন।
কিন্তু
এই দৃশ্যপটের নেপথ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল এক গোপন গুঞ্জন। ক্ষমতার অলিন্দে কিছু মানুষ নিজেদের
রাজনৈতিক লাভের জন্য সত্যিকারের এক বিপর্যয়ের অপেক্ষা করছে। তারা গোপনে বলাবলি করছিল,
“একটি বড় মুসলিম-লেবেলড হামলা হলে ধর্মীয় বিদ্বেষ আর আতঙ্কে ভোটের বাজার গরম হবে,
হিন্দুত্ববাদ শক্তিশালী হবে।” এই ভয়ংকর বাস্তবতা যদিও সরকার প্রকাশ্যে স্বীকার করবে
না, ক্ষমতার আড়ালে এটাই ছিল এক কদর্য সত্য।
কিছু
গোয়েন্দা অফিসার, যারা দেশের প্রতি অনুগত, তাদের অন্তর এই ঘৃণ্য চিন্তাকে ধিক্কার
দিলেও প্রকাশ্যে তারা নিরুপায়। মিডিয়ার সামনে এসে তারা সত্য বলার সাহস হারিয়ে ফেলে—মিডিয়াও
সেখানে বিজ্ঞাপন ও ক্ষমতার কাছে নতজানু।
এই সমস্ত
বাস্তবতা থেকে বহু দূরে, দিল্লির সাউথ এক্সটেনশনের একটি ছোট ফ্ল্যাটে গভীর রাতে নিভু
আলোয় বসে ছিলেন আতিফ খান। হাতে তার একটি পুরোনো নোটবুক, যার পাতাগুলোয় লেখা সতর্কবার্তার
কথাগুলো বারবার পড়েও যেন তিনি আশ্বস্ত হতে পারেন না। তাঁর মুখে গভীর বিষণ্ণতা আর অসহায়তার
ছাপ। ফোনে তাঁর স্ত্রী উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি এত চিন্তিত কেন?”
আতিফ
তিক্ত হাসি হেসে বললেন, “দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে দেখছি, দেশটাকে আমরাই দ্বিধাবিভক্ত
করেছি। কেউ কেউ মিডিয়ার সামনে স্রেফ নাটক করে, আবার কেউ গোপনে চান ভয়াবহ হামলা ঘটুক,
যাতে তারা ভোট পেতে পারেন। আর আমাকেই সবাই সন্দেহ করে—‘তুমি মুসলিম, কোনোদিন বিশ্বাসঘাতকতা
করবে!’”
স্ত্রী
শান্ত কণ্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “সবচেয়ে বড় সত্য আল্লাহ্ই জানেন। তুমি তোমার
দায়িত্ব পালন করছ, সেটাই বড় কথা।”
আতিফ
গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “হ্যাঁ, আল্লাহ্ই ভরসা। কিন্তু যদি সত্যিই এমন কিছু ঘটে,
আমি কীভাবে নিজেকে ক্ষমা করব?”
রাতের
গভীর শূন্যতায় বাইরের রাস্তায় কুকুরের করুণ বিলাপ, হাওয়ার শীতল স্পর্শ, যেন আতিফের
ভেতরকার দ্বন্দ্বের সাথে মিলে গেছে। শহরের এই নীরবতায় তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, দেশ
এক ভয়ানক অন্ধকারের দিকে এগিয়ে চলেছে।
অশনিসংকেত
কদিন
পরেই আকাশের বুকে অদ্ভুত এক লালিমা ছড়িয়ে পড়বে—যেন সূর্যাস্তের শেষে আকাশের কান্না,
গোধূলির ঘোরে প্রকৃতি রক্তের মতো লাল। সাধারণ মানুষের চোখে এটা এক নিছকই প্রাকৃতিক
দৃশ্য; কিন্তু প্রকৃতি কি আসলে কিছু বলতে চায়? গুয়াহাটির বুকের মধ্যে এই লালিমা,
সময়ের গভীর ফাটল থেকে উঠে আসা আগাম বার্তা—এক বিরাট রক্তপাতের অশুভ ইঙ্গিত।
গোপনে,
গুয়াহাটির নির্জন বাড়ির অন্ধকার কক্ষে ছায়ামূর্তির মতো কিছু মানুষ একত্রিত। টেবিলের
ওপর শুয়ে থাকা ধূসর সুটকেস—যার মধ্যে ঘুমিয়ে আছে মৃত্যু, যার নিঃশ্বাসে অপেক্ষা করছে
বিভীষিকা। তারা জানে না, সুটকেসের ভেতর বসবাস করে অদৃশ্য এক অগ্নিদেবতা—ক্রোধ, ধ্বংস,
বিভাজনের দেবতা—যিনি জেগে উঠবেন মানুষের অজ্ঞতা ও ঘৃণার আগুনে।
স্লিপার
সেল প্রস্তুতি নিচ্ছে, কণ্ঠে ধর্মের নামে যুদ্ধের মন্ত্র উচ্চারণ, অথচ তাদের চোখের
ভেতরে ভয় আর দ্বিধার ছায়া। মুখ্যমন্ত্রীকে নিশানা করা হবে, সেক্রেটারিয়েট ভবনে ফেটে
পড়বে সেই ছোট্ট বাক্সের ভেতরের মহাজাগতিক রাগ।
অন্যদিকে,
দিল্লির করিডোরে কিছু মুখ নীরবে হাসছে, চোখে শীতল হিসেব-নিকেশ, তারা অপেক্ষা করছে হামলার
জন্য। কারণ এ হামলায় তাদের জন্য সুবিধার বীজ রয়েছে—তারা ভোটের মাঠে ঘৃণা ও ভয়ের
ফসল কাটবে।
আর আতিফ
খান, একাকী নির্জনে লড়ে যাচ্ছেন নিজের দেশের সঙ্গে, নিজের ভেতরের বিবেকের সঙ্গে। রাতের
গভীরে তাঁর ছোট ফ্ল্যাটে দেওয়ালের ছায়াগুলো ফিসফিস করে বলে, "তুমি কেন লড়ছ?
এ লড়াইয়ে তোমার জয় নেই, শুধু অন্ধকারের সঙ্গেই তোমার বোঝাপড়া হবে।"
ভারতের
গোয়েন্দা সংস্থার দালানগুলো আজ যেন খালি বাড়ি, দেওয়াল থেকে ঝুলছে ফাঁকা ফটোফ্রেম,
অফিসের চেয়ারগুলোতে বসে আছে অনুপস্থিতির ছায়া। মিডিয়ার ঝলমলে আলোয় আসল তথ্য যেন
হারিয়ে গেছে। সন্দেহ ও বৈষম্যের করাল ছায়ায় মুসলিম অফিসারদের পা শেকলে বাঁধা। রাজনৈতিক
কূটচালে বাস্তব নিরাপত্তার দরজা আজ বন্ধ, সত্যের জানালায় তালা ঝুলছে।
এই বিকৃত
খেলার নিয়ন্ত্রকেরা নিশ্চিন্ত, কারণ ভোটের যুদ্ধক্ষেত্রে ঘৃণা আর বিভাজনই তাদের সবচেয়ে
বড় অস্ত্র। সেই অস্ত্রের সামনে রাষ্ট্র অসহায়, মানুষ অসহায়, প্রকৃতিও কাঁদে নিঃশব্দে।
আকাশের সেই রহস্যময়
লালিমা থেকে ভেসে আসে নীরব প্রশ্ন—"আর কতদূর চলবে এই অন্ধকারের নৃত্য? তোমাদের
বিবেক কি এতই ঘুমিয়ে গেছে যে, জাগানোর জন্য এই বিপর্যয়ই শেষ পথ?"
প্রকৃতির
অশ্রু লুকানো এই লাল আভায়, মানুষ হয়তো জানে না, ভবিষ্যৎ দাঁড়িয়ে আছে মৃত্যুর অপেক্ষায়।
আর সময় নিঃশব্দে বলে যাচ্ছে, "দেখো, কত সহজে তোমরা ভুলে যাও ভালোবাসার ভাষা,
আর গ্রহণ করো ঘৃণা ও মৃত্যুর অনন্ত চক্র।"
ষষ্ঠ অধ্যায়- বিষ্ফোরণ পর্ব
মঙ্গলবার
সকাল এগারোটা। গুয়াহাটির সেক্রেটারিয়েট ভবন জুড়ে স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা। বাইরের
উঠোনে সারি-সারি গাড়ি; ভেতরে করিডোরে ফাইল হাতে দ্রুত পায়ে চলমান কর্মকর্তাদের মুখে
নিরুদ্বিগ্ন দিনানুদিন ভাব। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, যার মুখে সর্বদা আত্মবিশ্বাসের
ছায়া, আজকেও মন্ত্রিসভার সভাকক্ষে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছেন এক কর্মকর্তার প্রেজেন্টেশন।
পাশের চেয়ারে বসে থাকা একজন অফিসার মাঝে-মাঝে অন্যমনস্ক হয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে
দেখছেন বাইরে রোদে ঝলমল করতে থাকা গাড়িগুলোকে। ভবনের ভেতরের লোকজনের কাছে বাইরে পার্কিং
লটের ব্যস্ততা ছিল অত্যন্ত সাধারণ ও গুরুত্বহীন দৃশ্য, যার দিকে কেউ আলাদা নজর দেয়
না।
ঠিক
তখনই, চারজন যুবক ধীর ও নিশ্চিত ভঙ্গিতে একটি ভারী মেটাল ট্রাঙ্ক নিয়ে পার্কিং লটে
এসে হাজির হল। ট্রাঙ্কের মধ্যে লুকানো ছোট একটি পারমাণবিক ডিভাইস—যার ক্ষমতা এক বা
দুই কিলোটন, একটি শহরকে মুহূর্তে ইতিহাসের অংশ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাদের হাঁটার
ভঙ্গি, চোখের নির্লিপ্ত চাহনি দেখে কোনো নিরাপত্তা কর্মীই সন্দেহ করার কোনো কারণ খুঁজে
পেল না। কাগজপত্র পরীক্ষা করে ছেড়ে দিলেন খুবই সাধারণ প্রক্রিয়ায়।
১১টা
১২ মিনিট। আশ্চর্যজনকভাবে পরিবেশে তখন কেমন যেন এক শীতল নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। করিডোরের
এক কোণে দাঁড়ানো একজন কেরানি ফিসফিসিয়ে বললেন, “আজকের দিনটা যেন কেমন—একেবারে নীরব।”
তার কথা কেউ শুনল না। মুখ্যমন্ত্রী তখন ফোনে কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে উত্তেজিত স্বরে
কিছু বলছেন, এবং সভাকক্ষে অন্যরা চুপচাপ শুনছে।
একজন
ক্লার্ক ডেস্ক থেকে উঠে জানালার ধারে গিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর মনে হলো, বাতাসে ভারী এক
শূন্যতা যেন ধীরে ধীরে সমস্ত কোলাহলকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তিনি ভাবলেন, হয়তো আজ প্রকৃতি
কোনো বড় ঘটনার অপেক্ষায় নিঃশ্বাস ফেলছে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে তিরস্কার করলেন এমন
উদ্ভট চিন্তার জন্য।
পার্কিং
লটে সেই চার যুবক দ্রুত সরে যাচ্ছে। ট্রাঙ্কের ভেতরে থাকা প্লুটোনিয়াম-কোর ইম্প্লোশন
ডিভাইসের রিমোট টাইমার তখন ইতোমধ্যেই চলতে শুরু করেছে। বিস্ফোরণের মুহূর্তে সেকেন্ডের
ভগ্নাংশ সময়ের ব্যবধান—তারপরই সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
মুখ্যমন্ত্রী
ফোনটা রেখে দিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন, সভার কক্ষে মুহূর্তের জন্য নেমে এল অস্পষ্ট
নিরবতা। প্রত্যেকে যেন কোনো অজানা সত্যের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ জানে না—এই অপেক্ষার
শেষেই আছে চিরস্থায়ী এক বিপর্যয়, যেখানে মানুষ ও মুহূর্ত মিলে এক হয়ে যাবে ইতিহাসের
নিষ্ঠুর পাতায়।
১১টা ১৫ মিনিট:
আলো থেকে অন্ধকারে
সাধারণ
একটি মঙ্গলবার। সেক্রেটারিয়েট ভবনের বাইরে, পার্কিং লটে হঠাৎ এক অসহনীয় আলোর ঝলক—পৃথিবীর
সমস্ত আলো যেন মুহূর্তে এই বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে। সেই আলো প্রথমে কেবল তীব্র,
তারপর যেন আরও উজ্জ্বল, আরও প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। সাদা, বীভৎস আলোতে প্রথমে চোখের মণি
বিস্ময়ে প্রসারিত হয়, তারপর সেই চোখেই ছড়িয়ে পড়ে বিভীষিকা। এক লক্ষ ডিগ্রি সেলসিয়াসে
মুহূর্তের জন্য সমস্ত কিছু গলে যায়, পার্কিং লটের গাড়িগুলো ধাতব তরলে পরিণত হয়ে
বাতাসে বাষ্পের মতো মিলিয়ে যায়।
এক সেকেন্ডের
কম সময়ের ব্যবধানে এই আলোর তীব্রতা থেকে সৃষ্টি হয় প্রচণ্ড এক শকওয়েভ—দৈত্যের অদৃশ্য
হাত যেন পৃথিবীকে মুষ্টিবদ্ধ করে ঝাঁকুনি দেয়। শব্দের গর্জনে সমস্ত শহর কেঁপে ওঠে,
আকাশ যেন নিজেই ফেটে পড়েছে। কয়েকজন মানুষ সেই আলোতে চোখ খুলতেই আর কিছু দেখতে পায়নি,
শুধু পুড়ে ছাইয়ে রূপান্তরিত হয়, তাদের আর্তনাদও সেখানে পৌঁছাতে পারেনি।
সেক্রেটারিয়েট
ভবনের নিচতলার কাঁচগুলো মুহূর্তে ভেঙে পড়ে, কংক্রিটের দেয়ালগুলি কাগজের মতো উড়ে
যায়। বহুতল ভবনের ভারী কাঠামো হঠাৎ নড়ে ওঠে, উপরের তলা থেকে আসবাবপত্র, মানুষ, কাগজপত্র
বিশৃঙ্খলভাবে পড়তে থাকে। রাস্তার পাশের ভবনগুলোর কাঁচ ভেঙে ঝরছে, রাস্তার মানুষজন
হতভম্ব হয়ে ছোটাছুটি করছে—কেউ বুঝতে পারছে না, তারা কী থেকে পালাচ্ছে।
মাত্র ১-২ কিলোটন: তবু কেন এত ধ্বংসাত্মক?
হিরোশিমার
সঙ্গে তুলনায়, ১-২ কিলোটনের একটি বিস্ফোরণ হয়তো 'ছোট' মনে হতে পারে, কিন্তু একটি
জনাকীর্ণ নগরীর কেন্দ্রস্থলে এই মাত্রার বিস্ফোরণ ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতি করতে যথেষ্ট। শহরের
মাঝখানে হাজার হাজার মানুষ, সরকারি অফিসের ঘিঞ্জি পরিবেশ, সেখানে বিস্ফোরণের শকওয়েভ
আর তীব্র তাপ এমন ধ্বংস ঘটায় যার কল্পনা করাও কঠিন। মাত্র কয়েকশো মিটারের ভেতরেই
বহু মানুষ মুহূর্তে অঙ্গারে পরিণত হয়।
প্রথম ঘণ্টায় (১১:১৫ - ১২:১৫): ভয়াবহ বিভ্রান্তি
১১:২০:
ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ক্ষীণ আর্তনাদের শব্দ ভেসে আসছে। আটকে পড়া মানুষদের দুর্বল
চিৎকার ছাড়া সেখানে অন্য কোনো শব্দ নেই। ধুলো আর ধোঁয়ার মেঘে ঢেকে গেছে সমস্ত দৃশ্যমানতা।
১১:৩০:
শহরের অন্যান্য প্রান্তে সোশ্যাল মিডিয়া ও ফোনের বার্তায় আতঙ্ক ছড়াতে শুরু করে।
সবাই জানতে চায়—“কী হয়েছে? সত্যিই কি পারমাণবিক বিস্ফোরণ?” কেউ বিশ্বাস করতে পারে
না, কিন্তু ক্রমশ তারা দেখতে পায় দূর আকাশে ঘন কালো ধোঁয়ার বিশাল স্তম্ভ।
১১:৪৫:
উদ্ধারকারীরা হন্তদন্ত হয়ে আসেন, তাঁরা জানেন না সেখানে তেজস্ক্রিয়তা রয়েছে। মানুষজন
হুড়োহুড়ি করে ধ্বংসস্তূপে ঢুকছে। অনেকেই পোড়া শরীর, ছিন্ন অঙ্গ নিয়ে বেরিয়ে আসছে।
১২:০০:
পুলিশ ও প্রশাসন সম্পূর্ণভাবে অসহায়। কেউ কিছু নির্দেশ দিতে পারছে না। মিডিয়া তীব্রভাবে
চিৎকার করছে, হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মুখ্যমন্ত্রী এবং
অন্যান্য কর্মকর্তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে কেউ জানে না।
দ্বিতীয় ঘণ্টায় (১২:১৫ - ১৩:১৫): নিরবচ্ছিন্ন আতঙ্ক
১২:১৫:
রেডিয়েশনের প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করেছে—পোড়া চামড়া, অসহ্য মাথা ঘোরা, রক্তক্ষরণ।
মানুষ এখনও জানে না তারা কতটা বিপদের মধ্যে আছে।
১২:৩০:
দমকল কর্মীরা আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, কিন্তু রাস্তা বন্ধ, পানি ও বিদ্যুতের
সংকট। আগুনের পাশেই অন্ধের মতো উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে, কেউ কেউ পায়ের নিচে তেজস্ক্রিয়
ধূলিকণা টের পাচ্ছে না।
১২:৪৫:
বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন এটা পারমাণবিক হামলা। রেডিয়েশন যন্ত্র নিয়ে তারা এগিয়ে
যান, কিন্তু ইতোমধ্যেই বহু উদ্ধারকর্মী বিপদের মধ্যে পড়েছেন। তেজস্ক্রিয়তার অদৃশ্য
শত্রু চারপাশে ঘিরে আছে, কিন্তু তা প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত কেউই নেই।
শহরের
বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে অজানা আতঙ্কে। সবাই বুঝতে পারছে, আজকের দিনটি ইতিহাসের পাতায়
চিরস্থায়ী ক্ষত হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেল।
. বিকাল ২টা - ৩টা: ধ্বংসের পরের নিঃশ্বাস
দুপুরের
সূর্য যখন নিস্পৃহভাবে আকাশে জ্বলছিল, তখন সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারগুলো বিস্ফোরণস্থলের
ওপর চক্কর দিচ্ছিল। ওপর থেকে দেখা দৃশ্যটা ছিল বিভীষিকার চেয়েও বেশি বাস্তব—একটি বিশাল
কালো গর্ত যেন পৃথিবীর বুকের গভীর ক্ষত। পার্কিং লট আর ভবন মিশে গেছে, পোড়া গাড়ির
ধ্বংসস্তূপ, লাশের স্তূপে ভরা চারপাশ।
১৪:৩০
মিনিটে অফিসিয়াল ঘোষণা আসে—মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা ও তার মন্ত্রিসভা সদস্যদের
কেউ বেঁচে নেই। এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে যেন সমগ্র আসাম প্রশাসন থমকে দাঁড়ায়, রাষ্ট্রের
হৃদপিণ্ড ধীর হয়ে আসা এক নিঃশ্বাসের মতো স্থবির হয়ে পড়ে।
১৫:০০
মিনিটে Fallout বা তেজস্ক্রিয় ধূলিকণা ধীরে ধীরে শহরের অদূরবর্তী এলাকায় ছড়িয়ে
পড়তে থাকে। মানুষের কাছে এগুলো ছিল অদ্ভুত এক ধূলোর মতো, যা রাস্তার ওপরে, গাড়ির
ছাদে এবং মানুষের শরীরে নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বুঝতে পারে না, এর মধ্যেই তাদের
শরীরে প্রবেশ করছে মৃত্যুর অদৃশ্য কণা।
বিকেলের বিভীষিকা:
মৃত্যুর প্রথম স্পর্শ
বিকেল
গড়ানোর সাথে হাসপাতাল ও উদ্ধারকেন্দ্রে আর্তনাদ ক্রমাগত বাড়তে থাকে। মানুষের তীব্র
পোড়া ক্ষত, শরীর থেকে চামড়া উঠে যাওয়া, রক্তের প্রবল প্রবাহ। বমি, মাথা ঘোরা, দুর্বলতা—এসব
ছিল Acute Radiation Syndrome-এর তীব্র প্রাথমিক লক্ষণ। কিছু চিকিৎসাকর্মী আক্রান্ত
হয়ে পড়েন—তারা সরাসরি রেডিয়েশনের সংস্পর্শে এসেছেন। তাদের চোখে আতঙ্ক আর বিভ্রান্তি।
মানুষের
মাঝে প্রশ্ন ছড়াতে শুরু করে, “কীভাবে আরও ছড়াবে? বাতাসে, পানিতে?” কেউ কেউ বলে ওঠে,
“এটা তো হিরোশিমা-নাগাসাকির মত না, এতটা ক্ষতি হবে না।” কিন্তু সবাই বুঝে যায়, তাদের
অদৃশ্য মৃত্যু ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে।
সন্ধ্যা ৬টা
- রাত ১০টা: সারা ভারতে আতঙ্কের ঢেউ
সন্ধ্যার
পরেও আগুন নেভানো যায়নি। শহরের ওপর ঝুলে থাকা ধোঁয়ার মেঘ ছিল জীবনের প্রতি এক নির্লিপ্ত
বিদ্রূপ। রেডিয়েশন মনিটরিং টিম দিশেহারা—যথেষ্ট সরঞ্জাম নেই, অথচ হাজার হাজার মানুষ
আক্রান্ত।
রাত
আটটার মধ্যে ভারতজুড়ে শোকের ছায়া নেমে আসে। প্রতিটি শহরে মিছিল, বিক্ষোভ, শোক মিছিল
বের হয়। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো একের পর এক ধ্বংসযজ্ঞের ছবি দেখিয়ে যায়, তাদের ভাষ্য
গর্জে ওঠে প্রতিশোধের দাবিতে। রাত দশটায় প্রধানমন্ত্রী মোদি টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে
ভাষণ দেন—“এ হামলা ভারতের আত্মার ওপর আঘাত। যারা দায়ী, তাদের কঠিন শাস্তি দেব। জরুরি
অবস্থা ঘোষিত হচ্ছে গোটা দেশে।”
পরবর্তী দিনগুলোর নীরব মৃত্যু
এই বিস্ফোরণের
পরবর্তী দিনগুলো ছিল আরও ভয়াবহ। Fallout-এর তেজস্ক্রিয় ধূলিকণা ধীরে ধীরে পাঁচ থেকে
দশ কিলোমিটার এলাকা দূষিত করে ফেলে। সামান্য বৃষ্টিপাতেও ভূগর্ভস্থ পানিতে বিষ ছড়াতে
থাকে, কৃষিজমিতে ছড়িয়ে পড়ে দীর্ঘস্থায়ী তেজস্ক্রিয়তা।
অসংখ্য
মানুষ হাসপাতালে ভর্তি হয়—রক্তে লোহিত কণিকার ধ্বংস, সংক্রমণ, শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা
ভেঙে পড়ে। মানসিক ট্রমায় আচ্ছন্ন অসংখ্য মানুষ। বাচ্চা ও অন্তঃসত্ত্বা নারীদের মধ্যে
জন্মগত ত্রুটি ও ক্যান্সারের আশঙ্কা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
গুয়াহাটির
হৃদয়ে এই বিপর্যয় দীর্ঘকালীন এক দুঃস্বপ্ন হিসেবে জমে থাকবে। ভারতের প্রস্তুতি ছিল
না এমন এক অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর বিরুদ্ধে। শহরের মাটি, বাতাস আর পানিতে মৃত্যু আজও নিঃশব্দে
বিচরণ করে, আর জীবিতরা নীরবে বহন করে মৃত্যুর ছায়া।
ধ্বংসস্তূপ ও পোড়া ভবিষ্যৎ
যে শহর
একসময় আসামের প্রাণের স্পন্দনে মুখর ছিল, সেই গুয়াহাটি আজ যেন কেবলই এক স্তব্ধ, ভৌতিক
মৃতপুরী। বাতাসে এখনো ভেসে আসে অ্যাম্বুলেন্সের করুণ আর্তস্বর, মাঝে-মাঝে ভেঙে পড়া
দালানের নিচ থেকে ক্ষীণ, অসহায় কান্নার আওয়াজ। সেক্রেটারিয়েটের জায়গায় আজ শুধু
এক বিশাল গর্ত, যেন পৃথিবীর বুকেই লেখা হয়েছে বিধ্বংসী বিষাদের কবিতা। ধ্বংসের ধূসর
ছাইয়ে ঢাকা পড়েছে পথঘাট, অফিস, দোকানপাট—আর ছড়িয়ে আছে মানুষের ভাঙা স্বপ্ন ও বিচ্ছিন্ন
হাত-পা।
অসংখ্য
পরিবার আজ তাদের প্রিয়জনের খোঁজে পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়; কেউ কেউ বুঝে গেছে তাদের
প্রিয়জন আর ফিরবে না, তবু অন্তরে শেষবারের মতো দেখা পাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। শহর ছেড়ে
পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে অনেকেই, কিন্তু কারো-কারো কাছে পালানোর জায়গাটুকুও অবশিষ্ট
নেই। বাধ্য হয়েই তারা তেজস্ক্রিয় দূষণের মধ্যে থেকে গেছে—অদৃশ্য মৃত্যুর সঙ্গে সহবাস।
মানুষের
ভিড় জমেছে অস্থায়ী ত্রাণশিবিরগুলোতে। চোখে তাদের আশঙ্কা, হাহাকার, আর অজানা ভবিষ্যতের
দিকে তাকিয়ে থাকা অসহায় মুখ। কেউ জানে না, কবে তারা ফিরতে পারবে সেই প্রিয় ঘরে—অথবা
আদৌ ফিরতে পারবে কিনা। বহু ঘর আজ তেজস্ক্রিয়তার করাল থাবায় বিষাক্ত, ফিরলে সেই ঘরই
হয়তো হবে মৃত্যুর কারণ।
এক অদৃশ্য,
দীর্ঘস্থায়ী দুর্যোগের ছায়া নেমেছে আসামে। আর্থ-সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে, কেউ
জানে না কীভাবে আবার শুরু হবে জীবন। সর্বত্র প্রশ্ন একটাই—"এত বড় পারমাণবিক হামলার
কথা কি কেউ ভেবেছিল?" প্রশ্নটি শহরের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয়, কিন্তু তার উত্তর
আজও অধরা। ষড়যন্ত্রের কালো পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে উল্লাস করছে কিছু বিকৃত মুখ, আর
গুয়াহাটির ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া মানুষদের ফিসফিসে কান্না যেন এই উল্লাসের বিপরীতে
এক করুণ, অন্তহীন শোকগাঁথা।
শোক ও প্রতিশোধের তীব্র আকাঙ্ক্ষা
গোটা
ভারত যেন আজ এক বৃহৎ শোকসভা। রাজপথে জ্বলছে হাজার হাজার মোমবাতি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম
ভেসে যাচ্ছে সহানুভূতির বার্তায়। একদিকে মানুষ গভীরভাবে শোকাহত, অন্যদিকে প্রতিহিংসার
আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। প্রতিটি হৃদয়ে আজ একটি প্রশ্ন—“কে করেছে এই নির্মম আঘাত?
পাকিস্তান, না বাংলাদেশ? কে দেবে এর জবাব?”
মিডিয়া
জানিয়ে দিয়েছে পারমাণবিক হামলার সিগনেচার পাকিস্তানের দিকে স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়। বাংলাদেশের
কিছু রুট ব্যবহার হয়েছে, এর পেছনে হয়তো আরও বড় হাত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের
মঞ্চে চীন-রাশিয়া কোথায় দাঁড়াবে, সেটা অজানা। যুদ্ধ নাকি শান্তি—দুটি পথের মধ্যেই
দাঁড়িয়ে গোটা দেশ। মানুষের মনে ক্রমাগত দোলা দেয় এক অজানা আশঙ্কা—একইসঙ্গে যুদ্ধের
ভয় আর প্রতিশোধের তীব্র ইচ্ছা যেন সমাজের বুক চিরে বইছে এক ঝড়ো নদীর মতো। ভারতের
ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকারের গভীর খাদে দুলছে, সময়ই কেবল জানে কোন পথে যাবে এই জাতি।
সপ্তম অধ্যায়: অভ্যুত্থানের ছক
হৃদয়ে দহন
গুয়াহাটির
সেক্রেটারিয়েটের কাছে ছোট একটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ যেন শুধু শহরের নয়, বরং
সমগ্র ভারতের অন্তরাত্মায় এক তীব্র ক্ষত সৃষ্টি করে। বিস্ফোরণের পরপরই সোশ্যাল মিডিয়া
এবং টেলিভিশনে ছড়িয়ে পড়া সেই বিভীষিকাময় দৃশ্যাবলী যেন বাস্তবের চেয়েও অবিশ্বাস্য
ও অবর্ণনীয়। মানুষের চিৎকার, পোড়া মৃতদেহ, ভেঙে পড়া ভবনগুলোর ধ্বংসস্তূপ ভারতীয়
জনগণের মনে এক অভূতপূর্ব আতঙ্ক ও ক্রোধ জাগিয়ে তোলে।
মুখ্যমন্ত্রী
হিমন্ত বিশ্বশর্মাসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষের মৃত্যুর খবরে গোটা দেশ মুহূর্তেই উত্তাল
হয়ে ওঠে। দিল্লি থেকে মুম্বাই, কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু—সর্বত্রই সাধারণ মানুষ রাস্তায়
নেমে আসে। চোখে-মুখে তাদের কেবলই ক্রোধ ও শোকের ছায়া। শহরের দেয়ালে, রাস্তায়, পোস্টারে
উঠে আসে প্রতিশোধের তীব্র দাবির ভাষা—"পাকিস্তানকে জবাব দাও," "বাংলাদেশকে
ছেড়ে দিও না!" বিভিন্ন হিন্দুত্ববাদী সংগঠন এই পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করে তোলে,
দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে থাকে।
দিল্লিতে
আবারও ডাকা হয় জরুরি বৈঠক। উচ্চপদস্থ সামরিক ও রাজনৈতিক কর্মকর্তাদের মুখে তখন গভীর
চিন্তার ছায়া, তাদের প্রতিটি কথায় ভেসে ওঠে আশঙ্কার অস্থিরতা। "কোথা থেকে এলো
এই আক্রমণ? এর পেছনে কারা?" প্রশ্নগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে চার দেয়ালে,
কিন্তু সঠিক উত্তর কারও জানা নেই।
ফরেনসিক বিশ্লেষণ
সরকার
দ্রুত গঠন করে বিশেষজ্ঞদের একটি নিউক্লিয়ার ফরেনসিক দল, যাদের কাজ ধ্বংসের কেন্দ্রে
ছড়িয়ে থাকা সূক্ষ্ম সূত্রগুলো থেকে এই পারমাণবিক হামলার উৎস খুঁজে বের করা। তারা
সতর্ক হাতে সংগ্রহ করতে থাকে প্লুটোনিয়ামের ক্ষুদ্র কণা, মাটির নমুনা, ধ্বংসস্তূপের
ছোট ছোট টুকরো, এবং বিস্ফোরণের কেন্দ্রে ছড়িয়ে থাকা রেডিয়েশন কণা। এই বিস্তৃত অনুসন্ধানের
মধ্য দিয়ে তারা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে সেই গোপন চিহ্ন—যা প্রকাশ করতে পারে এই
হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত উৎস।
বিস্তারিত
পরীক্ষায় বেরিয়ে আসে প্লুটোনিয়ামের নির্দিষ্ট আইসোটোপিক অনুপাত—যা স্পষ্টভাবে পাকিস্তানের
পারমাণবিক গবেষণাগারের স্বাক্ষর বহন করে। বিস্ফোরণের সার্কিট ও অন্যান্য অংশে পাকিস্তানি
প্রযুক্তির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কিন্তু সত্য কখনোই সরল নয়। কৌশলে বহু জটিল
পথে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে এই অস্ত্র ভারতে প্রবেশ করানো হয়েছিল।
সেই অদৃশ্য পথ ও গোপন কারিগরদের মুখোশ আজও রহস্যের অন্তরালে থেকে যায়।
এই সময়ে
ভারতের মানুষের মনে এক গভীর দ্বিধা ও অস্থিরতা দেখা দেয়—প্রতিশোধের দাবিতে জ্বলতে
থাকা অন্তরগুলোর বিপরীতে দাঁড়ায় অজানা যুদ্ধের আশঙ্কা। জাতীয় মনোভাব হয়ে ওঠে দোদুল্যমান।
এই কঠিন মুহূর্তে প্রতিটি ভারতবাসীর হৃদয়ে উদয় হয় ইতিহাসের অনিবার্য প্রশ্ন—কীভাবে
এগিয়ে যাবে ভারত, শান্তি না যুদ্ধের পথে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অধরা, ভবিষ্যতের
গর্ভে লুকানো।
দ্বিধা
দিল্লির
ক্ষমতার অলিন্দে সেই দিন এক জরুরি বৈঠকে, প্রতিরক্ষামন্ত্রী তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠেন,
“এটা নিছক সন্ত্রাস নয়, এটি আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের ওপর সরাসরি হামলা। পাকিস্তান
ও বাংলাদেশ এই ঘটনায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, তাই আমাদের পাল্টা সামরিক অ্যাকশন নেওয়া
ছাড়া বিকল্প নেই। প্রয়োজনে আমরা পারমাণবিক হুমকি দিতেও পিছপা হব না!” তিনি দৃঢ়তার
সঙ্গে বলেন, “এই হামলার মাধ্যমে আমাদের শত্রুরা এক স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে—তারা ভারতের
বিনাশ চায়।”
কিন্তু
তাঁর এই কঠোর মনোভাবের বিপরীতে, কিছু উর্ধ্বতন সামরিক অফিসার এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
কর্মকর্তা সতর্কতার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। একজন জেনারেল শান্ত স্বরে যুক্তি দেন,
“সরাসরি সামরিক আঘাত করলে চীন বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পারে, আর সেক্ষেত্রে ভারতকে
দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাতে হবে। পশ্চিমে পাকিস্তান, পূর্বে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক
চাপ—এটা হবে ভারতের জন্য বিশাল সামরিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়।”
পররাষ্ট্র
সচিব সংযতভাবে যোগ করেন, “সরাসরি পারমাণবিক প্রতিউত্তরে গেলে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতকেই
আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। বৃহৎ পরাশক্তির সমর্থন হারানোর ঝুঁকি রয়েছে, এমনকি
দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেবে।”
জাতীয়
নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল চুপচাপ সবার কথা শোনেন। এক মুহূর্তের নীরবতার পর তিনি
দৃঢ়ভাবে বলেন, “এনআইএ এবং সেনাবাহিনীর বিশেষ ইউনিট আগে যথাযথ প্রমাণ সংগ্রহ করুক।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে আমাদের একটি স্পষ্ট ও দৃঢ় বার্তা দিতে হবে, কিন্তু তাৎক্ষণিক বৃহৎ
সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। পাকিস্তান ও চীন সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো
তখন কী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, সেটা বিবেচনা করাও জরুরি।” ঘরের বাতাসে তখন অদ্ভুত এক
অনিশ্চয়তা ও উত্তেজনার মিশ্রণ ছড়িয়ে পড়ে।
চীন ও রাশিয়ার ভেটো
ভারত
জরুরি ভিত্তিতে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করে এবং সরাসরি অভিযোগ তোলে—“পাকিস্তান
ও বাংলাদেশ আমাদের বিরুদ্ধে যৌথভাবে পারমাণবিক সন্ত্রাস চালিয়েছে। আমরা পাল্টা পদক্ষেপ
নিতে বাধ্য হব।” কিন্তু সেখানেই ভারতকে মুখোমুখি হতে হয় কঠোর বাস্তবতার। চীন ও রাশিয়া
প্রস্তাবিত সামরিক পদক্ষেপকে ভেটো দিয়ে আটকে দেয়।
চীনা
প্রতিনিধি যুক্তি দেন, “ভারতের দেওয়া প্রমাণ এখনও সম্পূর্ণ নয়, ইসলামাবাদ ও ঢাকার
সরকার এই হামলার সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছে। সামরিক অ্যাকশন অগ্রহণযোগ্য
এবং উপমহাদেশের স্থিতিশীলতা আমাদের অগ্রাধিকার।” যদিও ভারত স্পষ্টভাবেই আন্দাজ করতে
পারে, চীন গোপনে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।
রাশিয়া
তুলনামূলকভাবে ভারসাম্য বজায় রেখে ভারতকে শান্তিপূর্ণ তদন্তের দিকে যাওয়ার পরামর্শ
দেয়। ইতিহাসগতভাবে ভারত-রাশিয়া সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলেও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার চাপে থাকা
রাশিয়া এখন চীনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে কথা বলে।
মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ্যে ভারতপন্থী অবস্থান নেয়, কিন্তু তারাও সতর্কতার সঙ্গে বলে,
“সামরিক উত্তেজনা এখন অত্যন্ত বিপজ্জনক।” ফলে ভারত আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে এক ধরনের
কূটনৈতিক আবর্তে আটকে যায়। যুদ্ধ ঘোষণা করা এখন অনেক কঠিন—দেশের জনমত আর আন্তর্জাতিক
বাস্তবতার দ্বন্দ্বে ভারত এক গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়।
উদ্বেগ
পাকিস্তানের
সরকারি মুখপাত্রের গলায় শোনা গেল এক শীতল আত্মবিশ্বাস। তিনি দৃঢ় স্বরে বললেন, “এই
ঘটনার সাথে আমাদের রাষ্ট্রের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। হয়তো কিছু বিচ্ছিন্ন, উগ্রপন্থী
জঙ্গিগোষ্ঠী এমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে, কিন্তু আমাদের সরকার কখনোই এই
ধরনের হামলা সমর্থন করে না।” যদিও তদন্তকারীদের হাতে থাকা পারমাণবিক উপাদানের সূত্র
সরাসরি পাকিস্তানের দিকে নির্দেশ করছিল, তবু আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সামনে তাদের মুখাবয়বে
প্রকাশ পায় এক রহস্যময় নির্লিপ্ততা।
অন্যদিকে,
বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট ইউনূস তৎক্ষণাৎ এক জরুরি প্রেস কনফারেন্স ডাকলেন। টেলিভিশন
ক্যামেরার সামনে তাঁর মুখাবয়বে স্পষ্ট ছিল চাপা উদ্বেগ। তিনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে
জানালেন, “আমি গভীরভাবে শোকাহত এবং এই হামলার প্রতি বাংলাদেশের কোনো প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ
সমর্থন নেই। ভারত যদি নির্ভুল প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে, তাহলে আমরা কঠোর ব্যবস্থা
নিতে প্রস্তুত।” তাঁর কথাগুলোতে ছিল আশ্বাসের পাশাপাশি গভীর এক হতাশার ছায়া, যা হয়তো
দর্শকদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েনি। ইউনূস ভালোভাবেই জানতেন, তাঁর প্রশাসনের ভিত্তি ভঙ্গুর,
এবং দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির। বিএনপি, জামায়াত, এমনকি সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ
কর্মকর্তারাও প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে না, যা তাঁকে গভীর অনিশ্চয়তায় ঠেলে দিয়েছে।
গোয়েন্দা অভিযান
গভীর
রাত। কলকাতার পার্ক সার্কাস ও মেটিয়া বুরুজের অন্ধকার, সংকীর্ণ অলিগলি হঠাৎই উত্তেজনায়
মুখরিত হয়ে ওঠে। ভারতের NIA ও CID-র যৌথ অভিযান শুরু হয়। সাদাকালো পুলিশের গাড়িগুলো
দ্রুতগতিতে এসে থামে, দরজাগুলো খুলে দ্রুত নেমে আসে সশস্ত্র গোয়েন্দা সদস্যরা। ঘরের
দরজা ভেঙে একের পর এক সন্দেহভাজন স্থানে প্রবেশ করে তারা। আতঙ্কিত বাসিন্দারা জানালা
থেকে আড়াল হয়ে দেখতে থাকে দৃশ্যগুলো। উদ্ধার হয় বিপুল সংখ্যক কম্পিউটার হার্ডডিস্ক,
জাল পাসপোর্ট, নকল আইডি কার্ড, অসংখ্য মোবাইল ফোন ও সিম কার্ড। গ্রেফতার হয় বেশ কিছু
সন্দেহভাজন, যাদের চোখে মুখে বিভ্রান্তি আর ভয়ের ছাপ।
অন্যদিকে,
মুর্শিদাবাদের গ্রামে গাফফার চাচার চক্র হঠাৎ করেই গা ঢাকা দেয়। গভীর রাতে শুরু হয়
কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাথে তীব্র বন্দুকযুদ্ধ। অন্ধকারের মধ্যে গুলির শব্দে গ্রামবাসীরা
ভয়ে আঁতকে ওঠে। কয়েকজন চোরাকারবারি পালিয়ে যায় সীমান্ত পার হয়ে, অন্যরা গ্রামের
গভীর অরণ্যে লুকিয়ে পড়ে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে।
ভারতীয়
মিডিয়া পরদিন উত্তেজনাকর শিরোনামে খবর প্রকাশ করে: “কলকাতা-মুর্শিদাবাদের মুসলিম মাফিয়ারা
পারমাণবিক বোমা পাচারে জড়িত!” দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই খবর দেশজুড়ে নতুন করে ছড়িয়ে
দেয় সামাজিক অস্থিরতা ও অবিশ্বাস। আতঙ্কিত মানুষ প্রশ্ন করতে শুরু করে—এর শেষ কোথায়?
এই উত্তেজনার ফলে ভারতীয় সমাজের ভিত ক্রমেই নড়বড়ে হতে থাকে, আর নেপথ্যে অদৃশ্য কোনো
হাত যেন ক্রমাগত ছড়িয়ে দেয় সন্দেহ ও আতঙ্কের বীজ।
গুয়াহাটির
আকাশ যেন পচা ধূসর কাপড়ে মোড়ানো; সূর্য আজকে এক বিষণ্ণ মুখোশের আড়ালে আত্মগোপন করেছে।
পৃথিবীকে যেন ঈশ্বর আজ পরিত্যাগ করেছেন, অথবা হয়তো ঈশ্বর আদৌ ছিলেন না। এখন তিনি নিশ্চিতভাবেই
নেই। মানুষের দীর্ঘ দিনের সভ্যতার অহংকার আজ তার নিজের বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে
হা হা করে হাসছে। সেই হাসির ধ্বনি আকাশে-বাতাসে মিশে গিয়ে যেন মানুষের সমস্ত যুক্তি
ও নৈতিকতাকে বিদ্রূপ করছে।
ভারতীয়
কর্তৃপক্ষদের ভিড়ের মাঝে গাইগার-মুলার কাউন্টারের একঘেয়ে টিক-টিক শব্দ অনন্ত এক নির্লিপ্ততার
সঙ্গে বেজে চলেছে। একের পর এক শরীরে যন্ত্র বসিয়ে চলেছে বিজ্ঞানীরা; একের পর এক মানুষ
প্রায় প্রেতাত্মার মতো শূন্য চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে। অথচ কারও মুখেই কোনো প্রশ্ন
নেই, যেন তারা উত্তরগুলো জেনেই গেছে। পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কেউ কেউ, কিন্তু
পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? রেডিয়েশন কোথায় নেই?
এক বৃদ্ধ,
মাথার চুল প্রায় সব ঝরে পড়েছে, চোখের কোণে রক্তের দাগ, দাঁড়িয়ে আছেন লাইনে। তিনি
আজও বুঝতে পারেন না কেন তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর পাশের একজন মহিলা বমি করে চলেছেন অবিরত।
হাসপাতালের করিডোরে মানুষ শুয়ে আছে মৃত অথবা মৃতপ্রায়। জীবিতদের চেহারায় মৃতের ছায়া,
মৃতদের মুখে জীবনের অবিনাশী আতঙ্ক। হাসপাতাল এখন নরকেরই প্রতিরূপ, ঈশ্বরের অনুপস্থিতির
নিখুঁত সাক্ষী।
মুহূর্তের
মধ্যে গুয়াহাটির প্রসিদ্ধ চা-বাগান আজ মৃত্যু ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে উঠেছে। ভারতীয়
চায়ের সুবাস এখন ছড়িয়ে গেছে আতঙ্কের দুর্গন্ধে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই পণ্য নিয়ে
ভয়াবহ সন্দেহ—এ পাতা কি বিষাক্ত নয়? ক্রেতা-বিক্রেতার চিরাচরিত বিশ্বাসের সম্পর্কে
আজ ঢুকে গেছে বিষাক্ত সন্দেহ। কৃষকেরা মাঠে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে দেখছেন দূরবর্তী দিগন্তে—যেন
তাদের সমস্ত শ্রম, সমস্ত আশা এক পরিহাসে বিলীন হয়ে গেছে।
মানুষের
অস্তিত্বই এখন প্রশ্নের মুখে। যে সভ্যতার জন্য তারা এতকাল গর্ব করেছে, আজ সেই সভ্যতাই
তাদের মুখে এক গভীর অন্ধকার এনে দাঁড় করিয়েছে। কেউ জানে না পরের দিনটা কী নিয়ে আসবে।
শুধু জানে যে আজকের পৃথিবীতে বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার মাঝে পার্থক্য খুব সূক্ষ্ম,
প্রায় অর্থহীন।
গভীরে ষড়যন্ত্র
ঢাকার
ক্যান্টনমেন্টের এক নির্জন, আলো-আঁধারি ঘরে বসে কর্নেল ফারুক, ব্রিগেডিয়ার সোহেল এবং
তাদের উচ্চপর্যায়ের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী। ঘরের বাতাসে তীব্র সিগারেটের ধোঁয়া ভেসে
বেড়াচ্ছে। সবাই জানে, এই ঘরে আজ রাতের অন্ধকারেই দেশের ভাগ্য নির্ধারিত হতে যাচ্ছে।
কর্নেল ফারুকের চোখে অদ্ভুত এক আত্মবিশ্বাস, মুখে প্রশান্ত হাসি। তিনি সোহেলকে লক্ষ্য
করে শান্ত গলায় বলেন, “দেখো, ইউনূস সরকার ইতোমধ্যে দিশেহারা। ভারত হামলার হুমকি দিচ্ছে,
ওরা কীভাবে সামাল দেবে সেটা নিয়ে তাদের কোনো ধারণাই নেই। আমরা এখন দেশের মানুষের আতঙ্ককে
পুঁজি করে ক্ষমতার সর্বোচ্চ আসনে উঠব।”
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল গম্ভীর স্বরে উত্তর দেন, “এখন সামরিক গোয়েন্দা, প্রশাসন, বেসামরিক অফিসার—সব
আমাদের হাতে। আমরা এত দিন ধরে অপেক্ষা করেছি, এবার সুযোগ একেবারে পরিপক্ক। ইউনূস সরকার
সম্পূর্ণভাবে অচল, বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সম্পূর্ণ দিশাহীন। সুতরাং, আমাদের বাধা দেওয়ার
কেউ নেই।”
ফারুকের
হাসি এবার গভীর হয়। তিনি কৌশলী স্বরে যোগ করেন, “আমরা ভারতের কাছে নিজেদের মিত্র সাজিয়ে
বলব, আমরা জানি কারা এই পারমাণবিক ষড়যন্ত্র করেছে। ইউনূস সরকার এই অবস্থার নিয়ন্ত্রণ
নিতে পারবে না—একমাত্র সামরিক শাসনই পারে এই বিপর্যয় সামাল দিতে। ভারত তখন সরাসরি
সংঘাত না বাড়িয়ে আমাদের মিত্র হিসেবে মেনে নেবে।"
কূটনীতির ছদ্মবেশ
এই সময়
গোপনে পাকিস্তানের আইএসআই-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে কর্নেল ফারুক। গোপন চ্যানেলের মাধ্যমে
পাঠানো বার্তায় তিনি জানান, “আমাদের পরিকল্পনা সফল। এখন খুব শীঘ্রই বাংলাদেশে সামরিক
অভ্যুত্থান ঘটবে। ইসলামিক মূল্যবোধের নামে ক্ষমতা দৃঢ় হবে, ইনশাআল্লাহ। আপনাদের সহযোগিতা
আমাদের একান্ত প্রয়োজন।”
অন্যদিকে
ঢাকার চীনা দূতাবাসে রাতের গোপন বৈঠকে কর্নেল ফারুক এবং সোহেল অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের
সঙ্গে বলেন, “ভারত আমাদের সাথে আপাতত সংঘাতে যাবে না। আমরা সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা
করলে বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিকভাবে চীনের স্বার্থ রক্ষা করব। ভারত এই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল
করতে চাইবে না, যদি আপনাদের সরাসরি সমর্থন আমাদের পাশে থাকে।"
ভারতেও
গোপনে বার্তা যায়, “ইউনূস সরকার অক্ষম, তারা জানে না কারা এই ষড়যন্ত্র করেছে। আমরা
সেনাবাহিনী হিসেবে অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সূত্র থেকে নিশ্চিত প্রমাণ দিতে পারি। সামরিক
সরকার প্রতিষ্ঠা করলে বাংলাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।"
এই গভীর
ও জটিল ষড়যন্ত্রের ঘূর্ণিপাকে, সাধারণ মানুষ কিছুই জানতে পারে না। শুধু রাতের অন্ধকারে
ক্ষমতার খেলার ছায়ারা ক্রমশ দীর্ঘ হতে থাকে, আর জাতির ভাগ্য এক অজানা ভবিষ্যতের দিকে
ধাবিত হতে থাকে।
নিরন্তর উৎকণ্ঠা
ঢাকার
পথঘাট, চায়ের দোকান, গলির মুখ—সর্বত্রই কেবল ফিসফিসানি। যেন শহরের বাতাসেই জড়িয়ে
আছে আশঙ্কার অস্পষ্ট প্রতিধ্বনি। ভারতীয় সীমান্তে সৈন্যদের আনাগোনা বেড়েছে, ভারতীয়
যুদ্ধবিমান নিয়মিত চক্কর কাটছে আকাশে। দেশজুড়ে অদ্ভুত এক শ্বাসরুদ্ধকর স্থবিরতা।
সবাই ভয় পায় উচ্চস্বরে কথা বলতে; শুধু মৃদুস্বরে কেউ বলে ওঠে, “এবার বুঝি আরেকবার
যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হবে? সেই একাত্তরের মতোই? কিন্তু এবারের যুদ্ধ আরও ভয়াবহ, আরও
অপ্রত্যাশিত—পারমাণবিক আতঙ্কে ঢাকা।” সাধারণ মানুষের চোখে-মুখে ফুটে ওঠে এক ধরনের অসহায়ত্বের
ছাপ; তারা জানে না ঠিক কী ঘটবে পরের মুহূর্তে।
ইউনূস
রাতের
গভীর নিস্তব্ধতায় বঙ্গভবনের বিশেষ কক্ষে বসেছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস। তাঁর চোখে গভীর উদ্বেগ, মুখের রেখায় যেন
সময়ের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। জরুরি ভিত্তিতে ডাকা এই গোপন সভায় হাজির বিএনপি
ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন বর্ষীয়ান নেতা। যারা সদ্য জেল খেটে এসেছেন। ইউনূসের কণ্ঠে উদ্বেগ ও হতাশার মিশ্রণ ফুটে ওঠে
স্পষ্ট—“আমরা এখন চরম সংকটের মধ্যে আছি। ভারতের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের মুখোমুখি, অথচ
আমরা জানি না, কীভাবে সামলাবো। আমি আপনাদের সাহায্য চাই, দেশের জন্য আপনারা এক হোন।"
কক্ষের
বাতাসে কয়েক মুহূর্তের জন্য অস্বস্তিকর নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। বিএনপির এক নেতা মৃদুস্বরে
বলেন, "বিস্ফোরণের সঙ্গে কি আওয়ামী লীগের কোনো অংশ জড়িত থাকতে পারে?" প্রশ্নটি
শুনে আওয়ামী লীগের নেতারা আহত চোখে তাকান, তাদের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ যেন ঘরের দেয়ালে
প্রতিধ্বনিত হয়। তারা বলতে পারেন না, শুধু স্মরণ করেন একাত্তরের সেই গৌরবময় ইতিহাস,
যখন নেতৃত্বের ক্ষমতা ছিল তাদের হাতে। এখন সব ক্ষমতা হাতছাড়া, অদৃশ্য ক্ষমতার জালে
আটকা পড়েছে দল।
ইউনূস
বুঝতে পারেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে কোনো সমাধান আসছে না। রাষ্ট্রযন্ত্র জটিল
ষড়যন্ত্রের মধ্যে আটকা পড়েছে। বাইরে থেকে ভারত যেকোনো সময় হামলা চালাতে পারে, আবার
ভেতর থেকেও সামরিক বাহিনীর একটা শক্তিশালী অংশ তাঁর বিরুদ্ধে ঘোর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
তিনি অসহায় হয়ে ভাবেন, সত্যিই কি আর কোনো উপায় নেই? এই গভীর সংকট থেকে দেশকে বাঁচানোর
আর কোনো পথ খোলা নেই? বঙ্গভবনের দেয়ালের ভেতরকার এই গভীর নিস্তব্ধতায় শুধুই শোনা
যায় এক নীরব, করুণ দীর্ঘশ্বাস—অন্ধকারের ভেতর আরও গভীর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাওয়া
এক দেশের অসহায় আর্তনাদ।
বিদ্যমান সংকট
গুয়াহাটির
বিস্ফোরণের পর, সময় যেন থমকে গেল। শহরের মাটিতে ছড়িয়ে থাকা রক্তের ছিটেফোঁটা, মানুষের
আর্তনাদ, সব মিলিয়ে এমন এক বাস্তবতার জন্ম দিল যার মুখোমুখি হওয়ার সাহস কারও ছিল
না। এই বিস্ফোরণ শুধু একটি ঘটনাই নয়; যেন মানবিক মূল্যবোধের গভীর সংকটেরই বিস্ফোরণ—যেখানে
বিশ্বাস, সহমর্মিতা ও নৈতিকতা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়েছিল।
বিশ্বরাজনীতির
দরবারে এক অবর্ণনীয় অন্ধকার নেমে এল। ভারত প্রতিশোধের আগুনে পুড়ছে—কিন্তু এই প্রতিশোধের
শেষে কি সত্যিই শান্তি রয়েছে? নাকি আরও গভীর গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে তাকে? প্রত্যেকটি
সিদ্ধান্ত, প্রতিটি ভাবনা যেন সন্দেহ ও আত্মজিজ্ঞাসার মধ্যে আবর্তিত হচ্ছে। অন্যদিকে
পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের সরকার মুখে নৈতিকতার অভিনয় করে চলেছে, অস্বীকার করছে সম্পৃক্ততার
অভিযোগ। অথচ গোপনে, অন্ধকার কক্ষে, আইএসআই এবং বাংলাদেশের সামরিক নেতাদের ঠোঁটে হিংস্র
এক বিজয়ের হাসি ফুটে উঠেছে। এই হাসি মানবতার মুখে পরিহাস, যেন সবই ক্ষমতার নিষ্ঠুর
খেলায় আত্মার বিক্রয়।
চীন,
সদা সাবধানী এবং হিসেবি, ভারতকে ব্যস্ত রাখতে চায়—যাতে নিজের অভিলাষ পূরণ করতে পারে
নির্বিঘ্নে। দেশগুলোর সম্পর্ক, মানুষের ভাগ্য—সবই যেন মহাপরিকল্পনার দাবার ঘুঁটি মাত্র।
রাশিয়া এই দোলাচলে কূটনৈতিক সমাধানের ডাক দিচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের সুবিধা মতো
দ্বিধাগ্রস্ত, জাতিসংঘের হলঘরে চলছে অন্তহীন বিতর্ক।
এদিকে
ঢাকায় স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে অভ্যুত্থানের ভয়াল পদধ্বনি। কর্নেল ফারুক, ব্রিগেডিয়ার
সোহেল—এই চরিত্রগুলো যেন দুর্বোধ্য এক অন্ধকারের সন্তান। তাদের চোখে জ্বলে কেবল ক্ষমতার
লোভ, হৃদয়ে নেই সত্যিকারের দেশপ্রেম, নেই মানবতার কোন স্পর্শ। তারা ভারতের দিকে হাত
বাড়িয়ে বলছে, “আমরা বন্ধু, আমাদের বিশ্বাস করো। শান্তি চাও তো আমাদের সাহায্য করো।”
অথচ এই একই হাত তারা বাড়িয়ে রেখেছে পাকিস্তান ও চীনের কাছে—হিংসা ও ষড়যন্ত্রের অন্ধকার
বন্ধুত্বে।
"যদি
ভারত না চায় আরেকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, তবে আমাদের সামরিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে।"
এই কথাগুলো যখন দিল্লিতে পৌঁছায়, সেখানকার নেতাদের মনের ভেতর জেগে ওঠে ভয় আর দ্বিধা।
তারা বুঝতে পারে না, সত্যিকারের শান্তির পথ কোনটি? এমনকি তারা ভুলে যায়, মানবতার মূল্যের
সামনে ক্ষমতা, দেশপ্রেম, প্রতিশোধ—সবই অর্থহীন।
এই নাটকে
আসলে সবাই বন্দি। প্রত্যেকে নিজের ভিতরের সত্যকে এড়িয়ে চলছে, নিজের মধ্যেই তৈরি করছে
এক ভয়ানক বিভ্রান্তি। ক্ষমতার অন্ধকার মোহে আবদ্ধ মানুষগুলো বুঝতে পারছে না যে, তারা
নিজেদেরকে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিচ্ছে। এই সংকটের আসল কারণ তাদের অন্তরের গভীর অসহায়তা,
নৈতিক দুর্বলতা এবং ঈশ্বরহীন শূন্যতা।
বাইরের
বিস্ফোরণ তো আসলে ভেতরের বিস্ফোরণের প্রতিফলন মাত্র—প্রত্যেকের আত্মার অন্ধকারেই আসল
যুদ্ধ। এবং এই আত্মিক যুদ্ধের পরিণতিই হয়তো নির্ধারণ করবে মানবজাতির ভবিষ্যৎ।
অষ্টম অধ্যায় :
অভ্যুত্থান পর্ব
ইতিহাসের গভীর অন্ধকার
ভারত
ও বাংলাদেশের ইতিহাস এক বিচিত্র নাটকের মতো—সেই নাটকে আছে রক্তের বাঁধন, বিশ্বাসঘাতকতা,
সামরিক অভ্যুত্থান, বন্ধুত্ব এবং চরম শত্রুতার অস্পষ্ট ছায়া। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে
ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশ জন্ম নেয়, অথচ ১৯৭৫-এর আগস্টে শেখ মুজিবের হত্যার পরে সেই
সম্পর্কের ভিত কেমন অদ্ভুতভাবে কেঁপে ওঠে। ভারত কখনও বাংলাদেশকে নিজের প্রয়োজনমাফিক
কাছে টেনে নেয়, আবার প্রয়োজন ফুরালে পেছনে ঠেলে দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে দেখা যায়,
জিয়াউর রহমান, এরশাদ—একাধিক সামরিক শাসক এলেও, তারা কেউই সম্পর্কের এই অদ্ভুত টানাপোড়েন
বদলাতে পারেনি। ভারতের রাজনীতিও স্থির নয়, কখনো কংগ্রেস, কখনো বিজেপি, ক্ষমতার পালাবদলে
বাংলাদেশের প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি বারবার বদলেছে।
আজ এই
ইতিহাসের গাঢ়, জটিল ছায়ায় দাঁড়িয়ে গুয়াহাটির পারমাণবিক হামলা—যেন সব সম্পর্ক,
সব চুক্তি হঠাৎ করেই তুচ্ছ ও অর্থহীন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতার দুর্নীতি, নৈতিকতার পতন,
সবকিছু মিলে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বাস্তবতা।
ফোনকল
গুয়াহাটির
বিস্ফোরণের পর ভারতীয় গোয়েন্দারা মরিয়া হয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এনআইএ
এবং সামরিক গোয়েন্দারা আটককৃত সন্দেহভাজনদের কাছ থেকে বের করেন অস্বস্তিকর সত্য—"বাংলাদেশের
সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এর সঙ্গে জড়িত।" পরমাণু ফরেনসিক স্পষ্ট করে
দেয়, প্লুটোনিয়ামের উৎস পাকিস্তান। ভারতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের দপ্তরে
রাতের নির্জনতায় এই সব প্রতিবেদন পড়তে পড়তে তাঁর মুখ কঠোর হয়ে ওঠে।
এমনই
এক গভীর রাতে তাঁর ব্যক্তিগত মোবাইলে বেজে ওঠে রহস্যময় একটি কল। তিনি রিসিভ করেন এবং
শুনতে পান অপর প্রান্তের কণ্ঠ—শান্ত, নির্লিপ্ত, এবং দৃঢ়।
“আমি
কর্নেল ফারুক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। আমি জানি এই হামলার নেপথ্যে
কারা রয়েছে। ইউনূস সরকারের দুর্বলতা ও ব্যর্থতা আমাদের দুই দেশকেই বিপদে ফেলেছে। আমরা
যদি এই সরকারকে সরিয়ে সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠা করি, আপনারা কি সমর্থন দেবেন?”
ডোভালের কণ্ঠে বিস্ময়
ও সতর্কতা, “আপনি কেন আমাদের বলছেন এসব?”
ফারুকের
গলায় এবার উঠে আসে এক অন্ধকার আত্মবিশ্বাসের ছায়া, “কারণ আপনারা এখন দুর্বল এক সরকারকে
পাশে নিয়ে কোনোভাবেই সন্ত্রাসকে প্রতিহত করতে পারবেন না। আমরা ক্ষমতা নিলে ভারত-বাংলাদেশের
সীমান্ত হবে নিরাপদ। সন্ত্রাসীদের আমরা নির্মূল করব—আপনারা থাকবেন নিশ্চিন্ত।"
ডোভাল
উত্তর না দিয়ে ফোন রাখেন, তার কপালে গভীর চিন্তার রেখা ফুটে ওঠে। তিনি জানেন, ক্ষমতা,
রাজনীতি, আর নৈতিকতার গভীর দ্বন্দ্বে কোনো সরল সমাধান নেই। তারপরও তিনি গোপনে ভারতের
উচ্চপর্যায়ে বার্তা পাঠান—"আমাদের সম্ভবত একটি নতুন, বিশ্বস্ত সামরিক সরকার দরকার।"
গভীর রাতের নিস্তব্ধতায়, দিল্লির ক্ষমতার করিডোরে ফিসফিসানি শুরু হয় এক অন্ধকার,
নৈতিকতাহীন সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাওয়ার।
শত্রুর আদল
কর্নেল
ফারুকদের মুখোশের আড়ালে প্রকৃত সত্যটি ছিল আরও অন্ধকার এবং জটিল। ভারত ভাবছিল তাদের
মিত্র হিসেবে, অথচ পর্দার অন্তরালে চলছিল এক গভীরতম ষড়যন্ত্রের মহড়া। ফারুক ও তার
সহযোগীরা দিল্লিকে বিশ্বাসের মিষ্টি কথা বলছে—“আমরা নিশ্চিহ্ন করব সব ভারত-বিরোধী শক্তি”—অথচ
অন্যদিকে রাতের গোপনীয় আঁধারে চলছিল পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে গোপন আঁতাত। তাদের মূল
লক্ষ্য স্পষ্ট—বাংলাদেশকে কুক্ষিগত করে ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ চাপিয়ে দিয়ে,
একইসাথে কৌশলে ভারতকেও দাবার ঘুঁটির মতো নিয়ন্ত্রণে রাখা।
এ ধরনের
দ্বিমুখী রাজনীতি মানব মনের অন্ধকারতম প্রকোষ্ঠেরই বহিঃপ্রকাশ। পৃথিবীর ইতিহাস জুড়ে
এই নাটক বারবার অভিনীত হয়েছে, কখনও ১৯৭৮ সালে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িক বন্ধুত্বের
আড়ালে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, কখনও মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-সৌদির প্রকাশ্য
শত্রুতার আড়ালে গোপন বোঝাপড়া। ১৯৬৫ কিংবা ১৯৭১ সালের সেই পাকিস্তান-চীনের অলিখিত
বন্ধুত্বের প্রতিধ্বনি যেন ফিরে এসেছে আবার। এখানে বন্ধুত্ব বা শত্রুতার বাস্তবতা নয়,
প্রকৃত সত্য হচ্ছে ব্যক্তিগত স্বার্থ আর ক্ষমতার নির্দয় ছলনা।
রাতের আঁধারে অপারেশন
ঢাকার
গভীরতম রাতটি যেন প্রস্তুত ছিল এক অভিশপ্ত নাটকের জন্য। ক্যান্টনমেন্টের নিশ্চুপ দেয়ালগুলো
যেন গোপন বিদ্রোহের সাক্ষী, যেখানে কর্নেল ফারুক, ব্রিগেডিয়ার সোহেল, মেজর ওয়াসিমরা
নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিচ্ছে দেশের ভবিষ্যৎ। যারা তাদের পথে বাধা হতে পারত, তারা আগেই
পাঠানো হয়েছে দূরের "শান্তিরক্ষা" মিশনে অথবা অন্য কোনো দূরবর্তী পোস্টিং-এ।
এভাবেই তৈরি হয়েছিল এক বিপজ্জনক শূন্যতা, যা ভরাট হবার অপেক্ষায় অন্ধকারতম শক্তির মাধ্যমে।
রাত
২টার অন্ধকারে ছড়িয়ে গেল সংকেত—“অপারেশন শুরু”। রাজধানীর রাস্তায় সামরিক ট্যাংক, সাঁজোয়া বাহিনীর শীতল, ধাতব উপস্থিতি।
অন্ধকারের নীরবতা চূর্ণ হয়ে গেল ট্যাংকের ভারী ট্র্যাকের শব্দে। রাত ৩টায়, বিদ্যুৎ
বন্ধ হয়ে গেল শহরের প্রধান স্থাপনায়; রেডিও, টেলিভিশন স্টেশন দ্রুত নিজেদের হাতে
নিয়ে নিল বিশেষ সামরিক বাহিনী। ফোন ও ইন্টারনেটের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে লাগলো ধীরে
ধীরে।
যে শহরটি
একটু আগেও ঘুমিয়ে ছিল নিশ্চিন্তে, তার মানুষগুলো এখন ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে বাড়ির ভেতরে
বন্দি। দু-একজন কৌতূহলী মানুষ বাইরে বেরিয়ে এক মুহূর্তের জন্য দেখেও আতঙ্কে ফিরে আসে
দ্রুত—“ট্যাংক! ট্যাংক এসেছে!” অতীতের অভিজ্ঞতা- তাদের চোখে ভেসে উঠলো ভয়াবহ স্মৃতির
মতো—১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৮৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের রক্তাক্ত ইতিহাস। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির
শীতল, নিষ্ঠুর সত্যের মুখোমুখি ঢাকা, পুনরায়।
ঢাকার
আকাশে তখনও ঘন কুয়াশার আস্তরণ, শহরের মানুষ নিশ্চিন্ত ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ টেলিভিশনের
স্ক্রিনে উদয় হলেন ব্রিগেডিয়ার সোহেল। তার মুখে ছিল কঠোর ও দৃঢ় একটি ছায়া। তিনি
দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করলেন, “দেশ আজ গভীর সংকটে নিমজ্জিত। জাতিকে রক্ষার জন্য সেনাবাহিনী
ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। প্রেসিডেন্ট ইউনূস নিরাপদে আমাদের হেফাজতে আছেন। শিগগিরই দেশে
একটি নতুন সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।”
এই ঘোষণায়
ঢাকার অলিগলিতে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ল। ঘুম ভেঙে গেল বহু মানুষের। কেউ স্তম্ভিত হয়ে
টেলিভিশনের পর্দার দিকে তাকিয়ে রইল। কেউ দ্রুত ফোনে পরিচিতজনকে জানাল, আবার কেউবা
হতাশায় বিড়বিড় করল, “ফের একবার সামরিক শাসন!” অনেকে ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেল। রাস্তায়
কেউ নামল না। শহরে নেমে এল এক ভয়াবহ নিশ্চুপতা।
ভারতীয়
দূতাবাসে কিছু কর্মকর্তারা আগেই জানত—তাদের সরকার নীরবে সমর্থন দিয়েছে। দ্রুতই চীন
এবং পাকিস্তান থেকে শুভেচ্ছা বার্তা আসতে শুরু করে। সবাই যেন চুপিসারে এই নতুন নাটকের
নেপথ্যে নিজস্ব লাভের হিসাব কষছে।
রাজনৈতিক দাবা
নয়া
দিল্লিতে, প্রধানমন্ত্রী ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের কক্ষে এই খবর পৌঁছলে তারা সতর্ক স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেললেন। গুয়াহাটির ঘটনার পরে সরাসরি যুদ্ধ এড়ানো গেছে, অথচ বাংলাদেশের সামরিক
জান্তার মাধ্যমে সীমান্ত নিরাপত্তাও সম্ভব হবে। ভারতের কৌশল পরিষ্কার—বড় যুদ্ধ এড়িয়ে
নতুন সামরিক সরকারকে 'বন্ধু' হিসেবে ব্যবহার করে সীমান্তে স্থিতিশীলতা আনা।
অন্যদিকে,
চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে কূটনীতিকরা নিঃশব্দে হাসলেন। তারা জানেন, ভারত কখনোই পুরোপুরি
বাংলাদেশের ওপর প্রভাব রাখতে পারবে না। বাংলাদেশে নতুন সামরিক সরকার ক্ষমতায় এলেই,
চীনের প্রভাব আরও বাড়বে। সামরিক সরঞ্জাম ও অবকাঠামো উন্নয়নে চীনের সাহায্য নিতেই
হবে।
ইসলামাবাদে,
পাকিস্তানি কর্মকর্তারা কফির কাপে চুমুক দিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলেন। বাংলাদেশের
সামরিক শাসনের ফলে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে চাপ কিছুটা কমবে। নতুন সামরিক সরকার ইসলামিক
মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিলে পাকিস্তানও কিছুটা সুবিধা পাবে।
সবাই
নিজেদের দাবার চাল দেয়, কিন্তু কেউই প্রকাশ্যে কিছু বলে না।
ক্ষমতা দখলের
নিখুঁত মানচিত্র
সামরিক
অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে আছেন কর্নেল ফারুক। তার হাতেই পরিকল্পনার সমস্ত সুতোগুলো। ঢাকার সেনানিবাস থেকে
গোটা দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন তিনি।
ব্রিগেডিয়ার
সোহেল নিয়ন্ত্রণ করলেন যোগাযোগ মাধ্যম ও প্রচারযন্ত্র। তার অধীনে থাকা রেডিও-টেলিভিশন
স্টেশনগুলো নতুন সরকারের ঘোষণায় সরব।
মেজর
ওয়াসিম নেতৃত্ব দিলেন সশস্ত্র ইউনিটগুলোকে। বঙ্গভবন, সচিবালয়, গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়
এবং রাজধানীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেনাবাহিনী ও ট্যাংক মোতায়েন করা হল। পুলিশের
উপরও কড়া নজর রাখা হয়েছে—যাতে কোনও প্রতিবাদী কণ্ঠ উঠতে না পারে।
ঢাকা
শহর ভোরের আলোয় এক নতুন, কঠিন ও অস্পষ্ট ভবিষ্যতের সামনে দাঁড়িয়ে।
অদ্ভুত আলোর রেখা
ভোরের
আবছায়ায় ঢাকা শহরের আকাশে এক অদ্ভুত কালচে
লাল আভা। মানুষ তখন ভয়ে বা কারফিউয়ের তীব্র শাসনে ঘরের ভেতরে আটকা। কেউ কেউ সাহস
করে জানালার পর্দা সরিয়ে তাকায়—চোখের সামনে উদ্ভট, অপ্রাকৃতিক সেই আলো স্থির হয়ে
থাকে ঘণ্টাখানেক। তারপর আচমকা নিঃশব্দে উধাও হয়ে যায়। এই রহস্যময় দৃশ্য দেখে মানুষের
হৃদয়ে জন্ম নেয় এক গভীর, অস্পষ্ট ভয়। কেউ বুঝে উঠতে পারে না—এটা কি সত্যিই প্রকৃতির
খেয়াল, নাকি ইতিহাসের এক অশুভ ইঙ্গিত?
চারদিকে
নীরবতা গভীর হয়, গাছপালার ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া হিমেল বাতাস যেন মানুষের আত্মাকেও
ছুঁয়ে যায় ঠাণ্ডা শিহরণ দিয়ে। পাখির কোলাহল স্তব্ধ হয়ে গেছে অজানা ভয়ে। এক প্রবীণ
মুক্তিযোদ্ধা তাঁর কাঁপা কণ্ঠে বিড়বিড় করেন, যেন নিজের সঙ্গেই কথোপকথন করছেন—“একাত্তরের
পর থেকে কতবার এই সেনাবাহিনীই ক্ষমতা নিয়েছে, কিন্তু আমরা যা চেয়েছিলাম তা কি আজও
কেবল বালির বাঁধের মতো ভেসে যাবে?”
অন্ধকার
বাতাসের গভীর নীরবতায় যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে,, “বন্ধু কে, শত্রু কে—কী আশ্চর্য কঠিন
তা বোঝা! ইতিহাস সাক্ষী—যে হাত গতকাল বন্ধুর মতো ধরেছিলাম, আজ তাকেই তো বন্দুকের নিশানায়
নিতে হচ্ছে।”
নতুন সরকার গঠনের নাটক
সকালের
আলো তখনো পুরোপুরি ফুটে ওঠেনি, রেডিওতে ধীরে ধীরে বাজছে একটি ঘোষণার সুর—সত্য ও ক্ষমতার
অদ্ভুত এক মেলবন্ধনে আবৃত। কণ্ঠস্বর দৃঢ় অথচ শান্ত: “ভারতীয় আগ্রাসন ও অভ্যন্তরীণ
ষড়যন্ত্র থেকে দেশকে রক্ষার জন্য সামরিক বাহিনী দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।
শীঘ্রই ‘জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ’ গঠিত হবে, যা দেশকে একটি শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খল ভবিষ্যতের
দিকে নিয়ে যাবে।"
প্রেসিডেন্ট
ইউনূসের ভাগ্যে নেমে এসেছে অপ্রত্যাশিত পতন। কেউ জানে না ঠিক কোথায় তিনি বন্দি রয়েছেন—হয়তো
একটি নির্জন রিসোর্টের কোনো নির্জন ঘরে বা সামরিক বাহিনীর গোপন গেস্ট হাউসের কোনও আরামদায়ক
অথচ শক্তভাবে পাহারা দেওয়া কক্ষে। যদিও সামরিক কর্তৃপক্ষের ভাষায় তাকে সম্মানের সঙ্গে
রাখা হয়েছে, বাস্তবে ইউনূসের ক্ষমতা এখন শুধুই একটি বিভ্রম। রাজধানীর মানুষজনের মনে
নীরব প্রশ্ন জমতে থাকে, কেউ কেউ অনিশ্চয়তায় ভোগে, আবার কেউ কেউ মনে করে—সম্ভবত এই
সামরিক পদক্ষেপেই শান্তি ও নিরাপত্তা ফিরে আসবে।
দেশের
রাজনৈতিক দলগুলো এ সময় স্পষ্ট কিছু বলতে চাইলেও তাদের গলার স্বর থেমে যায় সামরিক
বাহিনীর কঠোর হুমকি এবং কারফিউয়ের তীব্র নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ মানুষ ভাবছে, সরকারি
ব্যবস্থার ব্যর্থতার পরে হয়তো এমন সামরিক শাসনই প্রয়োজন ছিল। এক অদ্ভুত স্বস্তি যেন
মনকে ঘিরে রাখে, কারণ দীর্ঘদিনের অস্থিরতায় ক্লান্ত মানুষের জন্য শৃঙ্খলার আশ্বাসই
যথেষ্ট আকাঙ্ক্ষিত হয়ে উঠেছে।
নিঃশব্দ সম্মতি
ভারতের
রাজধানীতে আলোচনার সুরে সাবধানতার ছাপ। কেউ কেউ আশা করছে—বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব
স্থাপিত হলে হয়তো সীমান্তের সন্ত্রাস কমবে। তবে সামরিক বিশ্লেষকরা গভীরভাবে সতর্ক
করে দিচ্ছেন, সামরিক শাসন কখনো স্থায়ী সমাধান নয়। তারা আশঙ্কা করেন যে, নতুন এই সামরিক
সরকার ধীরে ধীরে চীন ও পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।
এই ভাবনার
মধ্যে ভারত সরকারের ভিতরে এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তৈরি হয়, বিশেষত অজিত ডোভাল এবং
তার ঘনিষ্ঠ মহলে। তাদের মতে, ইউনূসের ব্যর্থতার পরে এই মুহূর্তে সামরিক শক্তির কর্তৃত্বের
বিকল্প নেই। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে সাবধানী বিবৃতি দেয়,
"আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আমরা আশা করি, শীঘ্রই
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হবে।" যদিও এই সংযমী ভাষ্যের পেছনে আছে
ভারতের অপ্রকাশ্য, কিন্তু স্পষ্ট ও নীরব সম্মতি।
সবাই অভিনন্দন
সকালের
আলোতে এই নাটকের আরেকটি অদ্ভুত দৃশ্য ফুটে ওঠে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হঠাৎ করেই
অভিনন্দন জানিয়ে বার্তা পাঠান—"বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
মুসলিম উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থে এটি একটি প্রশংসনীয় পদক্ষেপ।" চীনের দূতাবাসও
তাৎক্ষণিকভাবে আনন্দ প্রকাশ করে এবং নতুন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতায় আগ্রহ প্রকাশ করে।
ভারত
নীরবতা অবলম্বন করলেও অন্তরে এক ধরণের স্বস্তি অনুভব করছে। যে দেশগুলো গতকাল পর্যন্ত
একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করেছে, আজ তারাই একসঙ্গে হাসিমুখে অভিনন্দন জানাচ্ছে।
এক বিস্ময়কর বাস্তবতা, যেখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ, ভূ-রাজনৈতিক চাপ, সামরিক জোট—সবই
মিলে যাচ্ছে একই বিন্দুতে। এক রাতের মধ্যেই বন্ধুত্ব ও শত্রুতার চিরাচরিত ধারণাগুলো
ধোঁয়াটে হয়ে ওঠে।
চিঠি
এখন
আমি লিখছি অন্ধকার থেকে। চারপাশে শুধু দেওয়াল, এক নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো বাতাসও নেই।
হ্যাঁ, দেওয়ালগুলো চোখে দেখা যায় না ঠিকই, কিন্তু আমার চারপাশের বাস্তবতার দেয়ালগুলো—অবিশ্বাস,
সন্দেহ, লোভ আর স্বার্থের যে অদৃশ্য প্রাচীর—সেগুলো অনেক বেশি শক্ত। কর্নেল ফারুক আর
ব্রিগেডিয়ার সোহেলরা ক্ষমতা নিয়েছেন। তারা নিশ্চিত, নিরাপদ; কারণ তাদের হাতে আছে
বন্দুক, ট্যাংক, গোয়েন্দা বাহিনী, আর আছে সেই স্বার্থের অস্পষ্ট লেনদেন। এই সবই তাদের
দেয় নির্ভার এক নিশ্চয়তা, এক আত্মতুষ্ট নির্লজ্জতা।
আমি
ভাবি, সাধারণ মানুষের কী হয়েছে? কোথায় তাদের সেই প্রতিবাদের কণ্ঠস্বর, যেখানে নৈতিকতার
দাবিতে তারা একদিন হয়তো মুখর হয়ে উঠেছিল? কিন্তু আমি নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর
জানি—তারা সবাই এখন নীরব, আতঙ্কে কিংবা সুবিধার আশায়। মানুষের ভেতরটা কী ভয়ানক বিচিত্র!
যখনই একটু সুযোগ পায়, তাদের বুকের ভেতরের নৈতিকতার ভান মুহূর্তেই চূর্ণ হয়ে যায়।
তারা সহজেই বিক্রি হয়ে যায়, কেনা-বেচার খেলায় তারা খুব সহজেই মেনে নেয় নিজেদের
নিঃসঙ্গ পরাজয়।
এখন
চারদিকে ফিসফিসানি—ভারত কি এবার আক্রমণ করবে? নাকি সামরিক জান্তা ভারতের বন্ধু হবে?
কেউ কিছুই জানে না। এই যে না জানার অসহায়ত্ব, এই যে শূন্যতার অনুভূতি, এটা যেন তাদের
আত্মারই প্রতিবিম্ব। তারা জানে না কারণ তারা জানতেই চায় না। তাদের সামনে সত্য নয়,
বরং ক্ষমতা আর স্বার্থের অন্তহীন নাটক। এ নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্র তাদের সামনে মুখোশ
পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, অথচ কেউই সেই মুখোশের পেছনে আসল মুখ খুঁজতে আগ্রহী নয়।
আমি
ভেবে অবাক হই, ইতিহাসের পাতায় বারবার এই একই গল্প—ফ্রান্স ও জার্মানি যুদ্ধ করেছে,
আবার বন্ধুত্ব করেছে; সোভিয়েত ও চীন একই আদর্শের নামে পরস্পরকে ঘৃণা করেছে। সিরিয়ায়
সব পক্ষেরই হাজারটা স্বার্থ, কেউই সত্যিকার মানবিকতার পক্ষে দাঁড়ায়নি। আজ বাংলাদেশ,
ভারত ও পাকিস্তান—একই রকমের ক্ষমতার খেলা। সেখানে নৈতিকতার কোনও স্থান নেই, নেই মানবতার
জন্য সামান্যতম চিন্তা।
ঢাকার
রাস্তায় এখন ট্যাংক, সেনাবাহিনী আর কারফিউ। মানুষ ঘরের ভেতরে বসে অপেক্ষা করছে—কিসের
অপেক্ষা তারা জানে না। একদিন, দুইদিন, হয়তোবা চিরকালই এই অপেক্ষার ভেতর বাঁচতে হবে
তাদের। ক্ষমতার এই নোংরা খেলার নিয়মগুলো হয়তো কখনো বদলাবে না, শুধু বদলাবে খেলার
পাত্র-পাত্রী। সত্যি বলতে কী, এই জঘন্যতা থেকে মুক্তি নেই আমাদের। এই নিষ্ঠুর সত্যই
হয়তো আমাদের ইতিহাসের প্রকৃত মুখ।
নবম অধ্যায়-গৃহযুদ্ধের শুরু
সামরিক শাসনের ছায়ায় গৃহযুদ্ধের পদধ্বনি
সেনাবাহিনী
ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিনগুলোতে মানুষের মনে সাময়িক স্বস্তির ছায়া ছড়িয়েছিল। কিন্তু
ক্রমশই বোঝা গেল, এই স্থিতিশীলতার অন্তরালে লুকিয়ে আছে ক্ষমতার নির্দয় প্রতিযোগিতা
এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির করাল গ্রাস। রাজধানীর হাওয়ায় তখন কান পাতলেই শোনা যায়
অস্পষ্ট ফিসফাস, অস্পষ্ট ভয়ের সুর। বিভ্রান্ত চোখে নাগরিকেরা দেখতে পায়, কীভাবে একটি
দেশ ধীরে ধীরে বিভক্ত হয়ে পড়ে—উগ্র ইসলামপন্থী, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে উদ্দীপ্ত সেক্যুলার
শক্তি, ভারত ও চীন-পন্থী গোষ্ঠী—যাদের প্রত্যেকের পেছনেই আছে সেনাবাহিনীর নির্দিষ্ট
কর্মকর্তার ছায়া কিংবা কোনো অদৃশ্য বিদেশি গোয়েন্দার হাত।
এই বিভক্ত
পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি কাঁপছে হিন্দু সম্প্রদায়। প্রতিদিনই তাদের ঘরের দরজায় অনিশ্চয়তার
থাবা । অচেনা মুখের মিলিশিয়ারা রাতের আঁধারে দেয়ালে লিখে যায়—“ভারতের চরদের রেহাই
নেই!” অথচ সামরিক শাসকরা নীরবে তাকিয়ে থাকে দূরের দিগন্তে। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে
সেক্যুলার বা ভারতপন্থী সৈন্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু তাদের শক্তি নগণ্য,
আওয়াজ ক্ষীণ, এবং অস্তিত্ব সংকটাপন্ন।
বিদেশি ছায়ার অদৃশ্য খেলা
সেনাবাহিনীর
অভ্যুত্থান যখন বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে গৃহযুদ্ধের অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছিল, তখনই স্পষ্ট
হতে শুরু করে বৃহৎ পরাশক্তিদের অদৃশ্য হাত। ভারত, চীন, আর পাকিস্তানের বহুমুখী স্বার্থজনিত
দ্বন্দ্ব—এ যেন বাঘ-ভালুক-সিংহের লড়াই, যার মরণকামড় এসে পড়েছে একটি ক্ষুদ্র মানচিত্রের
বুকে। দেশীয় গণমাধ্যমে অস্পষ্ট গুঞ্জন, অলিতে-গলিতে ফিসফাস—কেউ বলে, “পাকিস্তান ভেতরে
ভেতরে মদদ দিচ্ছে ইসলামপন্থী ওয়ারলর্ডদের”; কেউ বলে, “ভারত চায় ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র
নামে একটি সেক্যুলার দোসর সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে”; আর অন্যদিকে চীনের কূটনীতিকরা ছায়ার
পেছনে থেকে উসকে দিচ্ছে সামরিক শাসনের কঠোরতা, যেন ভারতীয় প্রভাবকে আটকে রাখা যায়।
রাজধানীর
আধভাঙা অফিসপাড়ায়, গোপন বৈঠকগুলোতে, বিদেশি গোয়েন্দাদের আনাগোনা এখন স্পষ্ট। কেউ
কেউ টের পায়, মধ্যরাতে অচেনা গাড়ি ঢুকে যাচ্ছে কোনো অভিজাত ক্লাবে। সেখানেই নাকি
বসে ভারতীয় ‘র’, পাকিস্তানের ‘আইএসআই’, আর চীনের সামরিক পরামর্শকদের গোপন আসর। তারা
বাংলাদেশের বিভাজিত বাহিনী ও ওয়ারলর্ডদের মধ্যে সীমানা টেনে দেয়, অর্থের টোপ ছুঁড়ে
দেয়, অথবা কোনো এক গভীর ষড়যন্ত্রের ছক কষে। যুদ্ধে ক্ষুধার্ত ওয়ারলর্ডরা বিদেশিদের
এই দানে নতুন অস্ত্র, অর্থ আর ক্ষমতার স্বপ্নে ডুবে থাকে। এই বুঝি বরফগলা নদীর মতো
গড়িয়ে পড়ে অস্ত্র ও রক্তের অন্ধকার স্রোত।
করাচি থেকে কলকাতা, আর বেইজিংয়ের বাঁকা
দৃষ্টি
পাকিস্তানের করাচিতে একসময় বাংলাভাষী শরণার্থীর বাস ছিল; ইতিহাসের পেছনে লুকিয়ে
থাকা সেই স্মৃতিবাহী মানুষদের কেউ কেউ আজ গোপনে অর্থ আর গোয়েন্দা সহায়তা পাঠাচ্ছে
মেজর জালালের দলে। রেডিওর তরঙ্গে ভেসে আসে “পাকিস্তানের পুরোনো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনো”—এক
বিচিত্র আহ্বান। নিষ্প্রাণ চোখে তালিবান-ছায়ার মিলিশিয়ারা কোরানের শ্লোগান তোলে,
আর জালাল নিজে মাইক হাতে ঘোষণা দেয়, “শরিয়া প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমরা শান্তি আনবো না!”
অথচ তার পেছনের অন্ধকারে বসে পাকিস্তানি দূতাবাসের কেউ মুচকি হাসে—এ যে ভারতের বিপক্ষে
এক মোক্ষম চাল!
ভারতের কলকাতায় অন্য রকম উদ্বেগ। বাংলাদেশ থেকে হিন্দু শরণার্থীর ঢল ঠেকানো অসম্ভব
হয়ে পড়েছে। গঙ্গার ওপারে শরণার্থীশিবির ফুলে ফেঁপে উঠছে। কিন্তু ভারতের সামরিক নেতৃত্ব
আসলে কী চায়? মুখে “মানবিক সহায়তার” কথা বলা হলেও, ছায়ার আড়ালে কেউ কেউ সমর্থন
জোগাচ্ছে ক্যাপ্টেন অমর আলীর সেক্যুলার বাহিনীতে—যেন পাকিস্তানপন্থীদের উত্থান থামানো
যায়। আবার একইসঙ্গে ভারতের শাসকগোষ্ঠীর কেউ কেউ চায় না বাংলাদেশ এত শিগগির স্থিতিশীল
হোক—কারণ অরাজকতা মানেই সামরিক-রাজনৈতিক চাপ বাড়িয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করা সহজ
হবে। সুতরাং ভারতের মধ্যেই দ্বিধাবিভক্তি—কেউ শরণার্থীদের রক্ষা করতে চায়, কেউ চাইছে
এই সংকট লালন করে বেশি নিয়ন্ত্রণ।
চীনের বেইজিংয়ে অবস্থান আর-ও জটিল। বরাবরের মতোই চীন ভারসাম্যের রাজনীতি চালায়—তারা
পাকিস্তানের পুরোনো মিত্র, আবার বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে ভারতকে
চাপে রাখতে চায়। তাই জেনারেলদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে তারা সরাসরি সামরিক রসদ
পাঠাচ্ছে ঢাকায় অবস্থিত সামরিক জান্তার কিছু বিশ্বস্ত গোয়েন্দা ইউনিটের কাছে। একই
সময়ে মেজর জালাল বা অন্যান্য ওয়ারলর্ডরা পরোক্ষভাবে সেই অস্ত্র কিনছে কালোবাজারে।
চীনের রাষ্ট্রদূত নিরাপত্তার অজুহাতে দূতাবাসে দিনরাত নিভৃতে বৈঠক চালিয়ে যান। কূটনৈতিক
গাড়িতে করে আসে কিছু কাঠের বাক্স—বলা হয় “চাল-ডাল, ত্রাণ সামগ্রী”, কিন্তু ভিতরে
থাকে রকেট লঞ্চার বা অত্যাধুনিক ড্রোনের যন্ত্রাংশ।
ছায়ায় আগুনের ফুলকি
একটি
যুদ্ধ শুধু পুরোনো মুখদের রক্তঝরা কাহিনিই নয়, নতুন মুখের আবির্ভাবও ডেকে আনে। এই
গৃহযুদ্ধের আঁধারে দেখা দেয় আরও কিছু চরিত্র—
গুপ্তচর ‘মালহারী সিং-হিমাচল প্রদেশের বৃত্তান্ত বলে পরিচয়
দিলেও, অনেকে বলে এটি তার ছদ্মনাম। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একজন প্রবীণ কর্মকর্তা,
যিনি অফিসিয়াল পরিচয়ের আড়ালে ক্যাপ্টেন অমর আলীর সাথে চুপিসাড়ে বৈঠক করেন। সেক্যুলার
শক্তিকে রক্ষার নামে অস্ত্র ও সামান্য অর্থ সহায়তা দেন। গ্রামের মানুষের কাছে নিজেকে
পরিচয় দেন ‘মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ী’, আসলে তার চোখে ফেলে রাখা ভারত সরকারের শত স্যাটেলাইটের
তথ্য—কোন রুটে পাকিস্তানপন্থীরা অগ্রসর হচ্ছে, কোথায় সেনাবাহিনীর ভেতরে বিদ্রোহ দানা
বাঁধছে, কোথায় আবার চীনা এজেন্টরা লুকিয়ে আছে। তার চোখ ঠাণ্ডা, স্থির; মানুষের দুঃখ-কষ্ট
তার কাছে যেন এক জটিল দাবার চাল মাত্র।
‘টিগ্রান চাও’ – চীনা অস্ত্রবণিক -নেপথ্যে থাকা এক চীনা ব্যবসায়ী, ‘টিগ্রান
চাও’ নামে পরিচিত। কূটনৈতিক পাসপোর্টের সুরক্ষায় সে ঢাকায় প্রবেশ করে, তারপর একরাতে
গাজীপুরের অন্ধকার পথে দেখা যায় তাকে মেজর জালালের লোকদের সাথে হাত মেলাতে। কেউ কেউ
বলে, সে আগে আফ্রিকার কয়েকটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে অস্ত্র সরবরাহ করেছে। ঠোঁটে সর্বদা
বিদ্রূপের হাসি—যেন বাংলাদেশ তার কাছে একটা নতুন ব্যবসার ক্ষেত্র। তার সঙ্গীরা চায়নামেড
ড্রোন, স্নাইপার রাইফেল আর নীরব ঘাতক মাইনের চালান নিয়ে আসে। টিগ্রান চাওয়ের চোখে
কোনো অনুশোচনা নেই, যতক্ষণ তার লাভ নিশ্চিত।
‘শাহ সুমের’ – পাকিস্তানি নীরব দূত-কেউ তাঁকে দেখলে ভদ্র চেহারার একজন কর্মকর্তা
ভাববে। কথায় উর্দু অ্যাকসেন্টের ঝংকার, পরিচয় দেয় ‘শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার
সমন্বয়ক’ বলে। অথচ রাত নামলে সে ঢাকার উপশহর any জায়গায় চলে যায়—মেজর জালাল থেকে
শুরু করে আরও কয়েকজন উগ্র ইসলামপন্থীর আস্তানায়। পুরোনো ফোনকলের রেকর্ডে শোনা যায়,
“বাংলাদেশকে আবার ৭১-এর আগের রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে যাব!”—এ এক সুপ্ত প্রতিশোধের উচ্চারণ,
কিংবা অন্ধকার ষড়যন্ত্র। জালালকে সে উৎসাহ দেয়, “ঘৃণাকে ধর্মের মোড়কে ছড়িয়ে দাও,
ভারতের চরদের ধ্বংস করো।” এতে পাকিস্তানি স্বার্থ কী? ভারতকে চাপে রাখা, আর পুরোনো
ক্ষোভের প্রতিশোধ—এই মিশ্র রসায়নেই শাহ সুমেরের সব পরিকল্পনা।
নতুন রাজত্ব: ছায়ার গভীরে অন্ধকারের উত্থান
সমাজ
যখন নৈতিক পতনের শেষ ধাপে পৌঁছায়, তখনই জন্ম নেয় নতুন ওয়ারলর্ডদের। সেনাবাহিনীর
পুরানো উর্দি ছেড়ে এখন তারা হয়ে উঠেছে এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি। দেশটা যেন এক বিশাল
ক্যানভাস, যার ওপর এঁকে চলেছে তারা ভয়াবহ এক দুঃস্বপ্ন।
মেজর
জালাল, একসময়ের সম্মানিত সামরিক কর্মকর্তা আজ উত্তরবঙ্গে গড়ে তুলেছেন এক ভয়াবহ মিলিশিয়া।
ধর্মের নামে শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়ে গ্রামে গ্রামে ছড়াচ্ছেন বিভীষিকা। গ্রামের
নিরীহ মানুষ বাধ্য হচ্ছে হাতে অস্ত্র তুলে নিতে, না হলে পরিবার হারানোর ভয়।
ক্যাপ্টেন
অমর আলী, সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন নিজের এক বিচ্ছিন্ন রাজত্ব। একসময়
ভারতপন্থী হিসেবে পরিচিত এই সেনা কর্মকর্তা নিজেকে সেক্যুলার শক্তির ত্রাতা দাবি করলেও,
তার বাহিনীও কখনো কখনো উগ্রতার শিকার। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের শিকার হয় নিরীহ পরিবারগুলো।
‘ডায়াবোলিক
দাদাভাই’, এই চোরাচালানি মাস্তান, যার সেনাবাহিনীর সাথে কোনও সম্পর্ক ছিল না, ক্ষমতার
শূন্যতায় এলাকার ত্রাসে পরিণত হয়েছেন। গ্রামের মানুষ তাকে টাকা দিয়ে কেনে নিজেদের
সাময়িক নিরাপত্তা। টাকা না দিলে তিনিই হয়ে ওঠেন সেই নির্যাতক, যার হাতে কারো জীবন
নিরাপদ নয়।
দেশের
ভূমি এখন এই ওয়ারলর্ডদের হাতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত। রাস্তায় রাস্তায় চেকপোস্ট,
ঘুষের বিনিময়ে নিরাপত্তা, গোপন বিদেশি চুক্তি—এসব এখন জীবনের অঙ্গ। তাদের ক্ষমতার
কাছে রাষ্ট্র হারিয়ে গেছে, সমাজ হয়ে উঠেছে ভয়াবহ বিভক্ত আর ছিন্নভিন্ন। এই নতুন
পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের কাছে বেঁচে থাকাটাই এখন সবচেয়ে বড় লড়াই।
সৈন্যদের বিদ্রোহ ও অস্ত্র পাচার
রাতের
আঁধার যেন বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এক অদৃশ্য আতঙ্কের জন্ম দিয়েছে। সেনাবাহিনীর
নিয়মিত সৈন্যরা বেতন না পেয়ে ক্রমশ বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে। তারা নিজেদের মধ্যে ফিসফিস
করে—অনিশ্চয়তা তাদের কণ্ঠে, চোখে জ্বলছে বিদ্রোহের লাল আলো। অন্ধকার রাতে সরকারি ক্যাম্পগুলো
থেকে গোপনে চুরি হচ্ছে অস্ত্র; রাইফেল, রকেট-লঞ্চার, মর্টার। যেন অন্ধকারে কিছু অশুভ
ছায়া নীরবে নিয়ে যাচ্ছে সেগুলো।
অস্ত্রগুলো
যাচ্ছে স্থানীয় ওয়ারলর্ডদের হাতে, যারা রাতের আঁধারে মুখোশ পরে অপেক্ষা করে থাকে।
তাদের মুখে অন্ধকার হাসি, চোখে অমানুষিক উল্লাস। এই অস্ত্র দিয়েই তারা তৈরি করে ভয়ঙ্কর
মিলিশিয়া বাহিনী। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে এই সশস্ত্র বাহিনীর ত্রাস। কেউ জানে
না কখন, কোথায় হানা দেবে তারা। অর্থের লোভ বা ধর্মীয় উগ্রতার আগুনে সাধারণ সৈন্যরা
বিশ্বাসঘাতক হয়ে উঠছে। সরকারপক্ষ কিংবা বিদ্রোহী পক্ষ—কে বন্ধু, কে শত্রু, বোঝা অসম্ভব।
গ্রামবাসীরা
ভয়ে তটস্থ। রাতের নীরবতা ভেঙে যায় হঠাৎই—বন্দুকের গর্জন, আর্তচিৎকার, ঘরের দরজা ভেঙে
পড়ার শব্দে। অস্ত্রের ব্যবসা হয়ে উঠেছে মানবতা ধ্বংসের এক অন্ধকার উৎসব। এক বৃদ্ধ
গ্রামবাসী অসহায়ভাবে বিড়বিড় করেন, “আমাদের রক্ষা করতে যারা এসেছিল, তারাই আজ সবচেয়ে
বড় শত্রু।"
লাশের স্তূপ ও ভয়াবহ নির্যাতন
গ্রামগুলোতে
নেমে এসেছে মৃত্যুর অন্ধকার। ইসলামপন্থী মিলিশিয়ারা স্লোগান দেয়, “হিন্দুদের চিহ্ন
নিশ্চিহ্ন হবে!” যেন ভয়াবহ এক অন্ধকার ভবিষ্যতের ঘোষণা। প্রত্যন্ত গ্রামে হামলার পর
আগুনের লেলিহান শিখা নিঃশেষ করে দেয় ঘরবাড়ি। মন্দিরের ভেতর আটকে রাখা হয় নারী-পুরুষ-শিশুদের।
আগুনে পুড়ে মরে তাদের আত্মার আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে বাতাসে।
রাস্তার
ধারে পড়ে থাকে শিশু ও বৃদ্ধদের নিথর দেহ। সেগুলো কেউ কুড়িয়ে নেয় না, পচে-গলে যায়
খোলা আকাশের নিচে। শিয়াল-কুকুর এসে দেহগুলো ছিঁড়ে খায়—মানব সভ্যতার চরম অবক্ষয়ের
এক ভয়াবহ চিত্র। মায়েরা সন্তান হারিয়ে পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। সীমান্তের দিকে
হাঁটতে হাঁটতে শিশুদের কান্নার শব্দ ছড়িয়ে পড়ে নিস্তব্ধ বাতাসে। তাদের চিৎকার রাতের
গভীর নির্জনতাকে করে তোলে আরও ভয়ঙ্কর।
ভারতের
সীমান্তে পৌঁছেও শান্তি নেই। অসহায় মানুষের মিছিল মহামারিতে আক্রান্ত। কেউ কেউ পথেই
মরে পড়ে থাকে। যেন সিরিয়ার ইদলিব বা আলেপ্পোর সেই ভয়াবহ দৃশ্য বাংলাদেশে ফিরে এসেছে।
মানুষ মানুষের প্রতি নির্মম হয়ে উঠেছে জাতিগত ও ধর্মীয় বিদ্বেষে। এই অমানবিক নির্যাতনের
দৃশ্য চোখে দেখতে দেখতে বাস্তবতা যেন ক্রমশ বিলীন হয়ে যায় এক জাদুবাস্তব জগতের অদ্ভুত
আবছায়ায়। কেউ কেউ বলে, গভীর রাতে মৃত মানুষদের আত্মারা ফিরে আসে প্রতিশোধের আশায়,
আর গ্রামগুলোর আকাশে ভেসে ওঠে অদ্ভুত আলোর রেখা, যেন মৃত আত্মারা মানুষের নৃশংসতার
বিচার করতে নেমে এসেছে পৃথিবীতে।
শরণার্থী শিবিরের অন্ধকার
পশ্চিমবঙ্গ,
আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয়—এই সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে ক্রমাগত ছড়িয়ে পড়ছে শরণার্থী শিবিরের
জটিল জাল। রাষ্ট্রের চোখ ফাঁকি দিয়ে অথবা প্রশাসনের অনীহায় মানুষ এসে আশ্রয় নিয়েছে
ছোট ছোট তাঁবু আর ভাঙা ঘরে। এখানে বেঁচে থাকার অর্থ শুধু শ্বাস নেওয়া—এর বাইরে বেঁচে
থাকার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। ত্রাণের নামে যা আসে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য; অধিকাংশ
সময় খাদ্য ও পানি পৌঁছানোর আগেই বিতরণে লেগে যায় মারামারি। খাবার পানি নেই, চিকিৎসা
দূরের কথা, একটি অ্যাসপিরিনের জন্যও দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষা করতে হয়।
শিশুরা
হাড়জিরজিরে শরীরে ঘুরে বেড়ায়, অপুষ্টি ও রোগে ক্লিষ্ট। কলেরা, ম্যালেরিয়া, ডায়রিয়ার
মতো সংক্রামক ব্যাধিগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে তাঁবু থেকে তাঁবুতে। মধ্যরাতে কানে আসে
মায়ের চাপা কান্না, সন্তানের মৃত্যুতে নিঃশব্দ আর্তনাদ। আর কোথাও নয়, এই শিবিরগুলোতেই
যেন মানব সভ্যতার সমস্ত অন্ধকার জমে গিয়ে একত্র হয়েছে। স্থানীয় মানুষজন ক্ষুব্ধ
চোখে তাকিয়ে থাকে, "এরা কারা? কোথা থেকে এসেছে? কেন আমাদের বোঝা বাড়াচ্ছে?"
এনজিও
বা হিন্দু সংগঠনগুলোর মাঝে মাঝে সামান্য ত্রাণ বিতরণে কিছু আশার আলো ফোটে। কিন্তু যারা
এসেছে, তারা শুধু খাদ্য বা বস্ত্র নয়, তারা চায় নিজেদের হারানো পরিচয় ও হারানো জীবনের
গৌরব। কিন্তু সেই হারানো স্মৃতিগুলো যেন রক্তাক্ত পোড়া ছবির মতো পিছনে পড়ে রয়েছে।
বাড়িঘর জ্বলেছে, আত্মীয়রা কোথায় হারিয়ে গেছে—এর উত্তর কেউ জানে না। এই গভীর হতাশা
শিবিরগুলোকে ধীরে ধীরে পরিণত করছে একেকটা জীবন্ত সমাধিস্থলে।
সিরিয়া
বা দক্ষিণ সুদানের ভয়াবহ শরণার্থী সংকটের মতোই, এই মানবিক বিপর্যয় ধীরে ধীরে ভারতসহ
সমগ্র উপমহাদেশকে এক অদৃশ্য আগ্নেয়গিরির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক
চাপ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যার সমাধান কারও কাছে নেই।
লোভের খেলা
সামরিক
সরকারের দুর্বলতার সুযোগে বিচ্ছিন্ন সামরিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রভাবশালী নেতারা
এখন নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে ওয়ারলর্ড হিসেবে। বাহ্যিকভাবে তাদের দাবি—জনগণের নিরাপত্তা
ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা। কিন্তু বাস্তবে তারা চালাচ্ছে ক্ষমতার নির্মম ব্যবসা। সড়কের মোড়ে
মোড়ে বসেছে চেকপোস্ট, কর বা টোলের নামে প্রতিদিন চলছে লুণ্ঠন। এসব ওয়ারলর্ডদের অধিকাংশই
এখন জড়িয়ে পড়েছে পশু-পাচার, অস্ত্র ব্যবসা ও মাদক চোরাচালানে।
কিছু
ওয়ারলর্ড আবার সাম্প্রদায়িক সংঘাতকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। হিন্দু নির্যাতন
ও সুরক্ষার দ্বৈত নাটক সাজিয়ে তারা জনগণের সহানুভূতি কুড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু
ভেতরে ভেতরে তারা নিজেদের সুবিধামতো যেকোনো শক্তির সঙ্গে আঁতাত করছে।
আন্তর্জাতিক
মিডিয়া এই গোলকধাঁধায় বিভ্রান্ত। তারা বুঝে উঠতে পারছে না, কে সত্যিকারের ন্যায়
প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে, আর কারা লড়ছে শুধু ক্ষমতা ও অর্থের লোভে। সত্য-মিথ্যার
এই ঘোরলাগা খেলায় সাধারণ মানুষ ক্রমাগত নিঃস্ব হচ্ছে—শুধু বস্তুগত অর্থেই নয়, হারিয়ে
যাচ্ছে তাদের শেষ বিশ্বাসটুকুও।
ক্যাপ্টেন
অমর আলী, যে একসময় নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের মহান উত্তরসূরি হিসেবে প্রচার করত, এখন সে
নিজেই রূপান্তরিত হয়েছে এক দুঃস্বপ্নে। তার বাহিনী গ্রামের পর গ্রাম ঘুরে বেড়ায়,
সন্দেহের বশে নিরীহ মুসলমানদের ধরে নিয়ে যায় নির্জন, অন্ধকার ডিটেনশন সেন্টারে। সেখানে
নৃশংসতার কোনও সীমা নেই। মানুষের আর্তচিৎকার, কাতরানো ধীরে ধীরে বিলীন হয় ঘরের দেয়ালে।
অমর আলী হাসতে হাসতে বলে ওঠে, “তোমরা সবাই পাকিস্তানের দালাল!” তার হাসিতে নিষ্ঠুরতার
নির্মম ছাপ।
গ্রামগুলোতে
আতঙ্কের নতুন এক ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষ পালানোর জায়গা খুঁজছে, এক অন্ধকার থেকে
অন্য অন্ধকারে আশ্রয় নিচ্ছে। নতুন ওয়ারলর্ডদের অধীনে তারা প্রতিনিয়ত নিজেদের মানবিকতা
হারাচ্ছে। সিরিয়ায় যা ঘটেছে, বাংলাদেশেও সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি। এখানে মানুষের
জীবনের মূল্য নেই, আছে শুধু ক্ষমতা ও নিষ্ঠুরতার অন্ধকার খেলা।
দুর্ভিক্ষের আলামত
যুদ্ধের
বিভীষিকায় বাংলাদেশের অর্থনীতি চূড়ান্ত ধ্বংসের মুখে। গ্রামের সঙ্গে শহরের যোগাযোগ
বিচ্ছিন্ন, খাদ্য ও ওষুধের সরবরাহ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে। দেশের সব বন্দর হয়ে উঠেছে
সংঘর্ষের রণক্ষেত্র। ধানের ক্ষেতগুলো আগুনে পুড়ে ছাই, পশুসম্পদ লুণ্ঠিত। খাবার নেই,
পানি নেই—মানুষ ক্ষুধার তাড়নায় পাগলের মতো ঘুরে বেড়ায়। বাজারে খাদ্যের দাম পৌঁছে
গেছে আকাশছোঁয়া।
শরণার্থীরা
পালাচ্ছে, যারা রয়ে গেছে তারাও মরছে ধীরে ধীরে, এক অসহ্য প্রতীক্ষায়। এই বিশৃঙ্খলায়
কেউ কেউ মুখ তুলে স্মরণ করে লেবাননের সেই গৃহযুদ্ধের দিনগুলোর কথা, যেখানে অর্থনীতির
সম্পূর্ণ পতন ঘটেছিল। মুদ্রার মূল্য তলানিতে, অস্ত্রের হাতে মরছে মানুষ, নয়তো শরণার্থীশিবিরের
অন্ধকারে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তাদের অস্তিত্ব। বাংলাদেশ আজ সেই একই অন্ধকার বাস্তবতার
সম্মুখীন—এখানে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ বলতে আর কিছুই নেই, আছে কেবল বিশৃঙ্খলা, নৃশংসতা
ও মানুষের অন্তহীন দুর্ভোগ
দূরের দৃষ্টি, নিঃশব্দ কান্না
বিশ্বের
ক্ষমতাধর দেশগুলোর চোখ যেন দূরবীনের কাঁচে আটকে গেছে—তারা দূর থেকে তাকিয়ে দেখছে বাংলাদেশের
রক্তাক্ত ভূগোল। ভারত উদ্বিগ্ন, কিন্তু সরাসরি সেনা পাঠালে চীন ও পাকিস্তানের পাল্টা
চাপের আশঙ্কায় নিথর হয়ে আছে। পাকিস্তান আর চীন নিজেদের লাভ-ক্ষতির হিসাবেই খুশি;
বাংলাদেশের আগুন তাদের কাছে ভারতের বুকের ক্ষত।
পশ্চিমারা
ইউক্রেনের বরফে ঢাকা মাটিতে কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত বালুকণায় বেশি মনোযোগী; বাংলাদেশের
আর্তনাদ তাদের কাছে স্রেফ বিবৃতি দেওয়ার বিষয়—“মানবাধিকার রক্ষিত হোক!” জাতিসংঘ এক
অক্ষম মধ্যস্থতাকারী, যেখানে রাশিয়া আর চীন শান্তিপ্রস্তাবের দরজায় ভেটোর তালা ঝুলিয়ে
রাখে। এভাবেই বাংলাদেশ যেন হয়ে উঠছে দ্বিতীয় সিরিয়া, এক শোকস্তব্ধ ধ্বংসস্তূপ।
হিন্দুদের করুণ আর্তনাদ
রাত
নামলেই হিন্দু পল্লীগুলোতে সন্ত্রাসী হামলা নামে, আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে বাতাস। অবিনাশ
দাস, পঁয়ষট্টি বছরের এক স্কুলশিক্ষক, মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ফোন হাতে কাঁপতে কাঁপতে
হাইকমিশনের নম্বরে বারবার চেষ্টা করেন। ওপাশ থেকে যান্ত্রিক গলা বলে, “এখন কিছু করার
নেই, সীমান্ত পর্যন্ত পৌঁছান, তবেই সাহায্য পাবেন।” এ কথার মধ্যে যেন ঠাণ্ডা নিষ্ঠুরতা।
সীমান্তে পৌঁছানো—এক অসাধ্য স্বপ্ন, যেখানে মিলিশিয়াদের হাতে বাঁধা হাজারো মানুষ।
প্রিয়াঙ্কা
নামের সাত বছরের একটি মেয়ে, সে বুঝতে পারে না কেন গত তিনদিন ধরে তার মায়ের চোখে শুধু
জল; কেন তারা বারবার ঘর বদল করে, কেন তার বাবা আর বাসায় ফিরে আসে না। এই দৃশ্য শুধু
মানুষের নয়, মানবতারও মৃত্যুর—এবং এই মৃত্যু এক নির্লিপ্ত দুনিয়া চুপ করে দেখছে।
মিলিশিয়ার রক্তক্ষয়ী নৃত্য
ঢাকা,
চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রাম—প্রতিটি জনপদ আজ মিলিশিয়ার শিকার।
রাস্তায় ব্যারিকেড, অস্ত্রধারীদের তল্লাশি, সন্দেহজনক চাহনিতে প্রত্যেকের পরিচয় নির্ধারণ।
পথঘাট বন্ধ, বাড়িঘর পুড়ছে, আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার স্বপ্নও অধরা। কোথাও
হিন্দু, কোথাও পাকিস্তানপন্থী, কোথাও ভারতপন্থী—সবাই আজ বিপদগ্রস্ত, বিভাজিত, একে অন্যের
বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে।
এক রাতে
ঢাকার গলিতে দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য—এক শিশু অনাহারে কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ থেমে তাকাল
আকাশে। ধোঁয়া আর আগুনের লেলিহান শিখার মাঝে সে দেখতে পেল এক অদ্ভুত আকৃতির পাখি—যেন
মানব কণ্ঠে বলে উঠল, “শান্তি কোথায়? শান্তি কোথায়?” গলির মানুষেরা থমকে গেল মুহূর্তের
জন্য। তারা জানে না, এই পাখি বাস্তব নাকি মরীচিকা, শুধু এই জানে যে শান্তি আজ অধরা,
এই বিভীষিকা থেকে মুক্তি আজ দূরের এক অস্পষ্ট আশার মতো।
মানুষগুলো
বাঁচতে চায়, কিন্তু চারপাশের এই নৈরাজ্য তাদের স্বপ্নকেও গ্রাস করছে। সময় যেন ক্ষতবিক্ষত,
শুধু বয়ে যাচ্ছে এক অনিঃশেষ দুঃস্বপ্নের মতো, আর পৃথিবী নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে
দেখছে—কেউ এগিয়ে আসছে না।
শেষ
পর্যন্ত মানুষের আত্মার অন্ধকার যেন উদ্ভাসিত হয়েছে নিষ্ঠুর বাস্তবতার আলোয়। কোনো
নৈতিক মূল্যবোধের উপস্থিতি নেই, সব কিছুর উপর শাসন করছে ক্ষমতার লোভ, নির্দয়তা, এবং
অবিশ্বাসের বিষাক্ত ছায়া। সিরিয়া বা লেবাননের মতো, বাংলাদেশও আজ সেই অনন্তকাল ধরে
চলা গৃহযুদ্ধ ও গণহত্যার দুঃস্বপ্নের জগতে প্রবেশ করেছে। রাস্তার পাশে লাশের স্তূপ,
গৃহহীন মানুষের আর্তনাদ, আর সেই সাথে অন্তর্নিহিত অসহায়তা—এই সমস্ত কিছু মানব অস্তিত্বের
গভীরতম অন্ধকারে হারিয়ে গেছে।
হিন্দু
সম্প্রদায়ের অধিকাংশ দেশ ছেড়েছে। যারা রয়ে গেছে, তাদের জীবন নরকের চেয়েও ভয়াবহ।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে মানুষগুলো হয়ে উঠেছে জীবন্মৃত, অর্থনীতি নিশ্চিহ্ন, দেশ এখন
পঙ্গু। উন্নয়ন, গণতন্ত্র, ভৌগোলিক অখণ্ডতা—এই সব শব্দ এখন অর্থহীন হয়ে পড়েছে রক্ত
আর অশ্রুর সমুদ্রে। ক্ষমতার অলিন্দে বসে আছে চীন, পাকিস্তান, ভারত—সবাই নিজেদের স্বার্থে
বিভোর, মানবতার নামে কোনও কিছু নেই তাদের অন্তরে।
সামরিক
জান্তা ক্ষমতা ধরে রাখতে নানা চুক্তিতে লিপ্ত। জনগণের শেষ আশার প্রদীপ নিভে গেছে অনেক
আগেই। কেউ হয়তো ভেবেছিল, কোথাও কোনো পরিত্রাণ থাকবে, কিন্তু বাস্তবতা নিষ্ঠুরভাবে
প্রমাণ করেছে—মানুষের আত্মায় কেবল অন্ধকার, নিস্তার নেই কোথাও। গৃহযুদ্ধের অগ্নিশিখা
নতুন ওয়ারলর্ড, নতুন বিদ্রোহ, আর চিরন্তন শত্রুতার আবর্তনে দেশটিকে গ্রাস করে নিয়েছে।
মানব সভ্যতার সমস্ত নৈতিক মূল্যবোধ আজ তলিয়ে গেছে অবিশ্বাস্য নৃশংসতার গহীন গর্ভে।
দশম অধ্যায় ঃ পরিণতি
পাঁচ
বছর কেটে গেছে, চারদিকে কেবল অন্ধকার আর অরাজকতার করাল ছায়া। কোথাও কোনো রাষ্ট্রীয়
কর্তৃপক্ষের ছিটেফোঁটা নেই, নেই সংবাদপত্র বা টেলিভিশনের শব্দ। সরকারি কোনো নিয়ন্ত্রণ
নেই, যেন সভ্যতা স্বয়ং নিজের সমাধিতে শুয়ে পড়েছে। ছোট্ট একটি প্রান্তিক শহরে পুরনো,
জীর্ণ রেডিওর ক্ষীণ ফ্রিকোয়েন্সিতে ভেসে আসে সংবাদ: “কর্নেল ফারুক, ব্রিগেডিয়ার সোহেল
ও তাদের সহযোগীরা ওয়ারলর্ড ফজলুল করিমের বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন এবং প্রকাশ্যে নির্মমভাবে
নিহত হয়েছেন। নগ্ন করে রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে এনে গুলি করে, পরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃতদেহ
প্রদর্শন করা হয়েছে। যেন আফগানিস্তানের নাজিবুল্লাহর সেই পুরনো, অশুভ পুনরাবৃত্তি।"
একটা
ঠান্ডা বাতাস রাস্তায় ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়, যেন মৃত্যুর ঘ্রাণ বহন করছে। ছোট্ট
সেই শহরের মানুষেরা স্তব্ধ, কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না। অন্ধকার ঘরে দরজা জানালা বন্ধ
করে তারা বসে থাকে, নিঃশব্দে কাঁদে অথবা ভয়ে কেঁপে ওঠে। একসময় কর্নেল ফারুক আর ব্রিগেডিয়ার
সোহেল যাদের কাছে ঈশ্বরের মতো ক্ষমতাধর ছিলেন, আজ তারাই একেবারে অসহায়—এক করুণ, বিবস্ত্র
মৃতদেহ, যা রাস্তায় ধুলো আর রক্তে মিশে গেছে।
কেউ
কি ভেবেছিল, যাঁরা পাঁচ বছর আগে ক্ষমতার সিংহাসনে বসে রাষ্ট্রের চাবিকাঠি হাতে নিয়েছিলেন,
ভারত, পাকিস্তান ও চীনের মতো পরাশক্তিকে আঙ্গুলের ডগায় নাচিয়েছিলেন, আজ তারাই অপমানজনক
মৃত্যুর শিকার হবেন? মানুষের আস্থা আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের গোলকধাঁধায় শেষ পর্যন্ত তারাও
হারিয়ে গেলেন। কে বন্ধু আর কে শত্রু, এখন আর কিছু বোঝা যায় না। মানুষ যে কত দ্রুত
মুখোশ বদল করতে পারে, তা দেখে মনে হয়—মানবিকতা আর নৈতিকতা আজ কত গভীরে সমাধিস্থ।
শহরের
রাস্তায় রক্ত আর কাদা মাখানো সেই দেহগুলোকে গাড়ির পেছনে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে যাওয়া
হচ্ছে, নিষ্ঠুর প্রতিহিংসার এক উন্মাদ উল্লাস। এই দৃশ্য দেখে পথের ধারে দাঁড়ানো বৃদ্ধ
আবদুল আজিজ চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, যেন মানুষের আত্মা ছিন্নভিন্ন হওয়ার বেদনা
তাঁর নিজের বুকেই অনুভব করছেন। পাশের বাড়ির জানালা থেকে একজন নারী তাঁর সন্তানকে আঁকড়ে
ধরে ফিসফিস করে বললেন, “চোখ বন্ধ করো, কিছু দেখো না—মানুষ আর নেই এখানে।”
আর ওয়ারলর্ড
ফজলুল করিম, এই মুহূর্তে এলাকার একচ্ছত্র অধিপতি, যেন সব মানবিকতা হারিয়ে পরিণত হয়েছেন
এক নতুন দানবে। তার হাসির আওয়াজ ভেসে আসে হঠাৎ করেই বাতাসে—সে হাসি নয়, এক ভয়ঙ্কর
অভিশাপ। এই নগ্ন প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে সে ঘোষণা করছে নতুন এক যুগের শুরু—যুগ যেখানে
নৈতিকতা মৃত, দয়া বা করুণা একটি বিস্মৃত শব্দমাত্র।
তিন টুকরো বাংলাদেশ
পাঁচ
বছরের নিরন্তর গৃহযুদ্ধ, বিদেশি হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় পরিচয়ের সংকটে বাংলাদেশ ভেঙে
গেছে তিনটি বড় অঞ্চলে। এই ভাগাভাগি শুধু ভৌগোলিক নয়, বরং গভীর দার্শনিক ও মানসিক
বিভাজনের প্রতীক। যেন তিনটি ভিন্ন বাস্তবতা, তিনটি ভিন্ন ভাগ্য, একই মাটির ওপর রচিত।
দক্ষিণ-পূর্ব
ও পূর্বাঞ্চল—ইসলামপন্থীদের করাল রাজত্ব। এখানে পাকিস্তান ও চীনের অর্থ এবং অস্ত্রের
সাহায্যে শরিয়া আইনের এক কঠোর বাস্তবতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মানব সভ্যতার বহু অগ্রগতিই
এখানে থমকে গেছে। নারী-শিক্ষা, স্বাধীন চিন্তা, সাংস্কৃতিক বহুত্ব—সবই অবরুদ্ধ এক কঠোর
ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণে। গ্রামে-শহরে টহল দেয় শরিয়া পুলিশের নিষ্ঠুর, নির্দয় চেহারা।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সামান্যই, কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে বিচ্ছিন্ন চুক্তিতে বহাল রয়েছে
তাদের অস্তিত্ব। বন্দরের জলে চীনা পতাকার জাহাজ এসে নোঙর ফেলে, অস্ত্র ও রসদের সরবরাহ
অব্যাহত রাখে। এখানকার ওয়ারলর্ড আবদুল হাকিম নিজের ছোটখাটো সাম্রাজ্যে নিষ্ঠুর একচ্ছত্র
আধিপত্য কায়েম করেছেন।
পশ্চিম
ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল—মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখা ভারতপন্থী একটি রাজ্য। এই ভূখণ্ডে
ভারতীয় সহায়তায় স্থাপিত হয়েছে নামমাত্র একটি শাসনব্যবস্থা, যেখানে সুশাসন ও সেক্যুলারিজমের
নামে চলছে কঠোর সেনা অভিযান। বিরোধী মতাবলম্বীদের জন্য নেই কোনও মানবাধিকার, নেই সঠিক
বিচারের অধিকার। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত—কখনও ধর্মীয় উগ্রতার নাম
নিয়ে, কখনও পাকিস্তানপন্থী সন্দেহের নামে। সীমান্তের ছোট শহরে শিক্ষক অরুণ সরকার দীর্ঘদিন
ধরে নীরবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, অন্তত কিছু শিক্ষার্থীকে মানবিক মূল্যবোধ শেখাতে।
ঢাকা
শহর ও তার আশপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এক ‘No-man’s land’—এক মহাকাব্যিক অরাজকতার কেন্দ্রে
পরিণত। এখানে স্বায়ত্তশাসন চাওয়া উপজাতি, ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠী, চাঁদাবাজ ও ওয়ারলর্ডদের
হিংস্র রাজত্ব। প্রতিটি গলির নিয়ন্ত্রণের জন্য সংঘর্ষ, অস্ত্রের ঝনঝনানিতে এখানে নিস্তব্ধ
শান্তি অচিন্ত্য। সাবেক কলেজছাত্র সুমন এই বিশৃঙ্খলার মধ্যে জীবিত থাকার লড়াইয়ে নেমেছে,
কখনও ছোটখাটো অস্ত্র ব্যবসায়, কখনও বা ত্রাণ সরবরাহের আড়ালে পাচারকারীদের সাহায্য
করে।
এই বিভক্ত
বাংলাদেশের কোথাও রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ অবশিষ্ট নেই। যেন এক অন্ধকার
ও দুঃস্বপ্নের অধ্যায়ে ডুবে গেছে সমগ্র জাতি।
লাশের সারি ও দুর্ভিক্ষ
এই পাঁচ
বছরে মানুষের মৃত্যু যেন হয়ে উঠেছে এক স্বাভাবিক বাস্তবতা। ত্রিশ লক্ষ হিন্দু এবং
আশি লক্ষ মুসলিমের প্রাণ গেছে—তবে সংখ্যার থেকেও ভয়াবহ তাদের মৃত্যুর নির্মমতা ও অবজ্ঞা।
হত্যা, নির্যাতন, খরা, দুর্ভিক্ষ ও মহামারির শিকার হয়েছে অসংখ্য মানুষ।
হিন্দুরা
সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়েছে। তাদের গণহত্যার চিত্র কল্পনার অতীত। অনেকে সীমান্ত পেরিয়ে
গেছে ভারতে, আর যারা পেছনে রয়ে গেছে তাদের জীবনে নেই কোনও নিরাপত্তা, নেই সম্মান।
তাদের ধর্ম-পরিচয় লুকিয়ে থাকা জীবনে পরিণত হয়েছে অবিরাম লাঞ্ছনার এক মর্মান্তিক
গল্পে। সীমান্তবর্তী গ্রামে বয়স্ক প্রিয়া দেবী নিজের পরিবারের মৃত্যু চোখের সামনে
দেখেছেন, আজ একাকী পথে পথে ঘুরে বেড়ান স্মৃতির ভারে নুয়ে পড়ে।
মুসলিম
সম্প্রদায়ও রেহাই পায়নি। ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে তারাও হয়েছে ভয়াবহ
হত্যাযজ্ঞের শিকার। ভারতপন্থী অঞ্চলে সন্দেহের বশে অসংখ্য নিরীহ মুসলিমের প্রাণ গেছে।
কিশোর আমিন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরে ঘুরে ঘুরে ছোট ভাইবোনদের জন্য খাবার খুঁজে বেড়ায়—জীবন
সেখানে এক দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি।
দুর্ভিক্ষের
ভয়াবহ বাস্তবতায়, খাদ্য ও পানির অভাবে শহর ও গ্রামের ধ্বংসস্তূপে পড়ে থাকে অসংখ্য
মৃতদেহ। রোগবালাই মহামারির মতো ছড়িয়েছে—কলেরা, পোলিও, ডেঙ্গু সবই নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
চিকিৎসা ও সাহায্যের জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও অসহায়—তাদেরও সম্মুখীন হতে হয়
স্থানীয় গেরিলাদের নির্মম শোষণের। রাস্তার পাশে মৃতদেহগুলো পচে যায়, কবর দেওয়ার
মানুষ নেই। মানুষ এখানে মরছে নির্বিকার প্রকৃতির সামনে—যেন সভ্যতার পরিসমাপ্তির এক
করুণ দৃশ্য।
শহর ও নগরী ধ্বংসস্তূপ
ঢাকা,
চট্টগ্রাম, খুলনা—একসময়ের প্রাণবন্ত শহরগুলো আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। বড় বড় কারখানাগুলো
এখন কেবলই আগুনে পুড়ে যাওয়া লোহার কাঠামো। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে ঠেকেছে;
দেশের প্রতিটি ব্যাংকের দরজা বন্ধ। কৃষিজমি আগাছায় ভরে গেছে, কৃষকেরা গ্রাম ছেড়ে
পালিয়েছে। আকাশে আজকাল কেবল কালো ধোঁয়ার মেঘ।
মাসুদ,
একসময়ের সফল উদ্যোক্তা, আজ ঢাকা শহরের ভাঙা কারখানার সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে। জীবনভর
শ্রম আর স্বপ্নের কারখানাটা এখন কেবল স্মৃতি। কাছে এসে তার মেয়ে সায়মা বলল, “বাবা,
আমরা কি এখান থেকে পালিয়ে যাব না? এখানে তো আর কিছুই নেই।"
মাসুদ
নির্বাক। তিনি জানেন না কোথায় যাবেন। চারপাশে কেবল মাদক-অস্ত্রের ব্যবসায়ীদের উৎপাত।
বন্দরের একাংশ চীনা কোম্পানির হাতে, অন্য অংশে ওয়ারলর্ডদের প্রকাশ্য তোলাবাজি। সীমান্তবর্তী
কিছু এলাকা ভারতে পণ্য পাচার করে কোনও রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটাও
যথেষ্ট নয়। পুরো দেশটা যেন আজ বিশ্ব মানচিত্রে এক অভিশপ্ত ভূখণ্ড।
কোটি মানুষের করুণ
যাত্রা
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় নতুন বাস্তবতার সূচনা—অসংখ্য শরণার্থী শিবির। সেখানে
আবদুল নামে এক বৃদ্ধ মানুষ, যিনি নিজের গ্রাম ছেড়ে পরিবার নিয়ে এসেছেন, বসে বসে তার
দুই নাতিকে দেখছেন। তারা দিনভর ক্ষুধায় কাঁদছে। পাশের তাঁবুতে কলেরা, ম্যালেরিয়া,
সংক্রমণের খবর; চিকিৎসা নেই, খাবার নেই। আবদুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করেন,
"আমরা কি সিরিয়া বা আফগানিস্তান হয়ে গেলাম?”
স্থানীয়
ভারতীয়রাও অস্থির; কেউ বলে, “এই শরণার্থীরা আমাদের রুটি কেড়ে নিচ্ছে। আমাদেরই এখন
অভাব।" কিন্তু আবদুলদের যাবার জায়গা নেই। মিয়ানমারের সীমান্তে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি;
কেউ কেউ চীনের দিকে যেতে চায়, কিন্তু পথ কঠিন। নৌকায় মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা
করেও বহু পরিবার সাগরে ডুবে নিঃশেষ হয়ে গেছে। বাঙালি পরিচয় আজ বহুদিক থেকে অবাঞ্ছিত
ও ঘৃণিত—এমন ট্র্যাজেডি তারা কল্পনাও করেনি।
নির্দয় নিষ্ঠুরতা
আল-বারাকা
ব্রিগেড, মুক্তি বাহিনী ৭১, গ্রেট বেঙ্গল আর্মি, জেএমবি-২—কী অদ্ভুত সব নাম! বাস্তবে
এসব মিলিশিয়া আসলে এক একটি দানবীয় বাহিনী। তাদেরই এক কিশোর সদস্য, রাকিব, বয়স ১৫।
চোখে-মুখে মাদকের প্রভাব, হাতে একে-৪৭। তারা এক হিন্দু গ্রামে আগুন দিয়েছে, রাকিবের
হাতে প্রাণ হারিয়েছে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ। রাতে সে ঘুমোতে পারে না; চোখ বন্ধ করলেই
ভেসে আসে সেই মৃতদের মুখ। কিন্তু দিনের আলো ফোটার সাথে সাথে আবার হাতে অস্ত্র নিতে
হয়—পালানোর পথ নেই।
পুতুল
সরকার ও সামরিক নেতৃত্ব এসব ওয়ারলর্ডদের কাছে অসহায়। মাঝেমধ্যে ভাগাভাগি চুক্তিতে
নামমাত্র শান্তি আসে। কর্নেল ফারুক ও সোহেলরা মাঝখানে পড়ে গিয়েছিল, তারা মধ্যস্ততার
চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আজ তারাও নেই; আরও নিষ্ঠুর শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছে। কেউ আর
ক্ষমতার নেশায় নিরাপদ নয়। আজকের শিকার আগামীকালকার শিকারিকে জন্ম দেয়—এই সত্য এখন
দেশের প্রতিটি গলির রক্তাক্ত দেয়ালে লেখা।
জাতি পরিচয়ের অবসান
জাতীয়
চেতনার ভেতর এক গভীর বিভ্রান্তি এসে মানবতার অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকে পচিয়ে তুলেছে।
এ বিভ্রান্তি থেকে জন্ম নিয়েছে এক চূড়ান্ত নৈতিক ধসের পর্ব, যেখানে ঈশ্বরের নামে
মানুষের আত্মাকে বেচে দেওয়া হচ্ছে। শরিয়া আইনের অধীনে থাকা এলাকায় নারী স্বাধীনতা
যেন এক চিরতরে নির্বাসিত অচেনা শব্দ—ঘরের চার দেয়ালে নারী আটকা পড়েছে কেবল ছায়া
হয়ে, জীবন হয়ে উঠেছে তার কাছে নিরবচ্ছিন্ন কারাগার। সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানদের
চোখে দেখা যায় নির্বাক আতঙ্ক, যেখানে জীবনের আশা শুধু মৃত্যুর অপেক্ষা, সেখানে আলো
বলতে আছে কেবল নির্যাতনের গাঢ় অন্ধকার।
অন্যদিকে,
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধ্বজাধারী ভারতপন্থী অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে নির্মম সামরিক
বাহিনীর নিষ্ঠুর হাত, যেখানে মুক্তির প্রতিশ্রুতির আড়ালে বিরোধীদের কণ্ঠ রুদ্ধ। ভারতীয়
সেনারা কখনো কখনো সীমান্ত অতিক্রম করে তাদের ক্ষমতার হিংস্র প্রদর্শনী করে যায়; মানুষের
জীবন যেন নিছক ক্ষমতার দাবা খেলায় একটি ছোট বোড়ের টুকরো মাত্র।
জাতীয়
ঐক্যের ভিত্তি, যা একদিন সমগ্র জাতিকে মিলিয়ে রেখেছিল, আজ তা এক চূড়ান্ত বিভক্তিতে
ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। পশ্চিমাঞ্চলের "মুক্তিবাহিনী" নিজেকে স্বাধীনতার পতাকাধারী
দাবি করে, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে নেই কোনো মুক্তির ছোঁয়া, কেবলই রক্ত ও ভয়ের উল্লাস।
পূর্বাঞ্চলের "ইসলামি ক্যালিফেট" নিঃশব্দে শাসন চালাচ্ছে এক অদৃশ্য, নিরন্তর
নিপীড়নে। মধ্যাঞ্চলের "ন্যাশনাল রিভোলিউশনারি কাউন্সিল" এর বিপ্লবী স্লোগানের
আড়ালে প্রতিদিন প্রাণহানির নিষ্ঠুর বাস্তবতা।
এই বৈচিত্র্যময়
পতাকা ও স্লোগানের পিছনে চাপা পড়েছে সাধারণ মানুষের নিঃসঙ্গ কান্না ও অসহায় আর্তনাদ।
মানবিকতার সর্বোচ্চ পতন আর অসহায়ত্বের চরম রূপে এক নিঃশেষিত নাটক প্রতিদিন মঞ্চস্থ
হচ্ছে, যেখানে নৈতিকতার মৃত্যু হয়েছে অনেক আগেই।
ধ্বংসস্তূপ
আজ আবার
ফিরে এসেছে সেই অভিশপ্ত দিন—৫ই আগস্ট, যে দিন থেকে শুরু হয়েছিল এই অন্তহীন বিভীষিকার
যাত্রা। পাঁচ বছরের এই নরকযন্ত্রণার শেষে সমগ্র দেশ পরিণত হয়েছে এক অতিকায় শ্মশানে,
যেখানে মৃত্যুই একমাত্র সত্য, জীবনের অর্থ সেখানে নিঃশেষ। রাজধানী ঢাকা আজ কেবলই রক্তাক্ত
ধ্বংসস্তূপের শহর। আকাশচুম্বী ভবনগুলো আজ শুধু পোড়া কংক্রিটের কঙ্কাল, দেয়ালের গায়ে
বোমার ক্ষতচিহ্ন যেন চিৎকার করছে এক নিষ্ঠুর সত্যের গল্প। রাস্তার কোণে পড়ে থাকা মরদেহগুলোর
চোখে জমে আছে নির্বিকার হতাশা, তাদের পাশে কংক্রিটের ধ্বংসাবশেষে আটকা পড়া শিশুদের
অর্ধমৃত মুখ থেকে ক্ষীণ কণ্ঠে বেরিয়ে আসে অনন্ত কাতরতা, ক্ষুধার্ত হাতগুলো বাতাসে
উঠে ভিক্ষা চায় যেন চিরকালের মতো।
রাস্তার
ওপর ঝলসে যাওয়া গাড়ির মধ্যে থেকে মাঝে মাঝে এখনো বেরিয়ে আসে মানুষের করুণ আর্তনাদ,
কিন্তু তা কানে পৌঁছালেও হৃদয়ে আর সাড়া জাগায় না। মানবতার মৃত্যু হয়েছে, সাহায্যের
জন্য কেউ এগিয়ে আসে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, কারখানা, বন্দর সব আজ অতীতের কেবল স্মৃতি,
বাস্তবে তাদের অস্তিত্ব নেই। খাদ্যের জন্য চলছে হিংস্র লড়াই, হানাহানি ও রক্তপাত;
মানবপাচারের অন্ধকার বাণিজ্য গ্রাস করেছে পুরো জাতিকে।
রাষ্ট্রযন্ত্রের
আর কোনো অস্তিত্ব নেই—প্রাক্তন সামরিক শাসন বহুকাল আগে ভেঙে পড়েছে অসংখ্য ওয়ারলর্ডের
ছোট ছোট বর্বর রাজ্যে। তারা নিজেদেরকে দেবতার মতো ভেবে নিয়ে মানুষকে শাসন করছে রক্ত
ও নিপীড়নের মাধ্যমে। মানবজাতির এই করুণ ট্র্যাজেডির ভেতর প্রতিটি জীবন হয়ে উঠেছে
কেবল নিষ্ঠুর পরিহাস, এক অসহ্য দুঃস্বপ্নের মতো, যেখানে বেঁচে থাকা আর মৃত্যুর মধ্যে
কোনো পার্থক্য নেই।
: গিনেস বিশ্বরেকর্ডের
নৃশংসতা
মানব
ইতিহাসের অন্যতম অন্ধকারময় অধ্যায়ে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার
সংস্থার রিপোর্ট—এখনো সঠিকভাবে কেউ নিশ্চিত নয় মৃতের প্রকৃত সংখ্যা কত। আনুমানিক ত্রিশ
লক্ষ হিন্দু ও আশি লক্ষ মুসলিম প্রাণ হারিয়েছে—একের পর এক গণহত্যা, ধর্ষণ, অনাহার
ও আত্মহত্যার মাধ্যমে। পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের ঢল নেমেছে, রাজ্যের পরিকাঠামো পুরোপুরি
ভেঙে পড়েছে। একসময়ের প্রাণচঞ্চল কলকাতা এখন সন্ত্রাসের ভয়ে নিস্তব্ধ, প্রতিটি রাস্তার
কোণে সেনা মোতায়েন। ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গকে তিনটি পৃথক কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ভাগ করে
নিয়েছে—নিরাপত্তার নামে আসলে আরও গভীর অসহায়তা ও নিপীড়নের জন্ম দিয়েছে এই সিদ্ধান্ত।
মালদহের
নিরঞ্জন দাস নামে এক বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক চোখের সামনে দেখছেন নিজের পরিবারকে নির্মমভাবে
শেষ হয়ে যেতে—মেয়েকে পাচারকারীরা তুলে নিয়ে গেছে, ছেলে নিখোঁজ। অবশেষে তিনি একদিন
নিজেকেও হারিয়ে ফেলেন, গঙ্গার পাড়ে ভাসতে থাকে তাঁর নিথর দেহ।
ভ্রাতৃঘাতী পরিণতি
১৯৭১
সালের সেই মহিমান্বিত স্বাধীনতার স্বপ্ন আজ পরিণত হয়েছে এক নিষ্ঠুর পরিহাসে। একসময়
যে স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিল মানুষ, আজ সেই স্বাধীনতা মানুষকেই গ্রাস
করছে। ভারত, যার হাত ধরে এসেছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা, আজ তার চোখে নেই সেই দিনের বন্ধুত্বের
আলো—শুধু ক্ষমতার ঠান্ডা হিসাব। বাংলাদেশ আজ আত্মবিনাশের পথে ছুটছে—অন্ধকার, হিংস্রতা
আর মৃত্যুর বৃত্তে বন্দি। এই বিভীষিকার পেছনে আছে মানুষের চিরন্তন ব্যর্থতা, যেখানে
বারবার ইতিহাসের শিক্ষাকে অস্বীকার করে মানুষ ফিরে যায় তার আদিম প্রবৃত্তির কাছে।
পশ্চিমবঙ্গের
চিত্রও করুণ—মানবতার শেষ আশ্রয় যেন ধ্বংসের পথে। শরণার্থীদের চাপে পশ্চিমবঙ্গ ভেঙে
পড়েছে, বিভক্ত হয়ে গেছে কেন্দ্রীয় শাসনে। কলকাতা শহর আজ শুধুই ভাঙা দেয়াল ও হতাশ
মানুষের দীর্ঘশ্বাসে ভরে উঠেছে। মানুষ ভুলে গেছে তার আসল পরিচয়—শুধু ক্ষমতার জন্য
হারিয়েছে নিজের মানবিক চেতনাকে। তারা আজ শুধু হিংসা ও বিভেদের পূজারী।
এক কিশোরের হতাশা
ঢাকার
ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে একটি কিশোর নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে থাকে, তার নাম রাজু। হাতে ধরা
আছে পুরনো, বিবর্ণ বাংলাদেশের পতাকা। চারদিকে মৃত্যুর অসহ্য গন্ধ, রক্তের দাগ, এবং
মানুষের পরিত্যক্ত আশা। পতাকাটি যেন তাকে জিজ্ঞাসা করছে—“এই স্বাধীনতা কি সত্যিই আমাদের
মুক্তি দিয়েছে? নাকি কেবল নতুন শিকলে আবদ্ধ করেছে?” রাজুর চোখে জেগে উঠেছে গভীর এক
অস্তিত্বের বেদনা, তার আত্মার গহীনে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এক নিরর্থক প্রশ্ন—"মানব
জীবনের কি আসলেই কোনো অর্থ আছে, নাকি সবই কেবল নির্মম নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস?"
সীমান্তের
ওপারে, পশ্চিমবঙ্গের নির্জন পথে তেরো বছরের সুলেখা হাঁটছে। তার পেছনে পড়ে আছে তার
পরিবারের শেষ স্মৃতি—বাবার নিথর দেহ, মায়ের আর্তনাদ। তার চোখে নেই অশ্রু, মুখে নেই
অভিযোগ। সে জানে না তার যাওয়া কোথায়। তার প্রতিটি পদক্ষেপ যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে
এক অসীম অন্ধকারে, যেখানে প্রতিটি আশাই কেবল শূন্যতার দিকে যায়।
আজকের
বাংলাদেশ আর সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ নয়—এটি এখন কেবলই এক বিভাজিত, ধ্বংসপ্রাপ্ত ভূখণ্ড,
যেখানে ওয়ারলর্ডরা তাদের হিংস্র রাজত্ব স্থাপন করেছে। কর্নেল ফারুক ও ব্রিগেডিয়ার
সোহেল, যারা একসময় ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেছিল, আজ তাদের মৃতদেহ ঝুলে আছে জনসম্মুখে, তাদের
জীবন পরিণত হয়েছে ক্ষমতার নিষ্ঠুর খেলার বলিতে।
হিন্দু
সম্প্রদায় বিলুপ্তির মুখোমুখি, তাদের সংস্কৃতি ধ্বংসের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। মুসলিম
সম্প্রদায় নিজেদেরই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মানবতার এই চরম পতনে বাংলাদেশ
আজ সিরিয়া, রুয়ান্ডা, বসনিয়ার মতো ট্র্যাজেডিতে পরিণত। আজকের বাংলাদেশ যেন মানব
অস্তিত্বের অর্থহীনতারই এক নির্মম উদাহরণ।
মানুষের
কান্না ও চিৎকার বাতাসে ভেসে যায়, কিন্তু কেউ শুনতে পায় না। এই নিষ্ঠুর বাস্তবতায়
প্রত্যেকে ক্লান্ত, হতাশ এবং পরাজিত। জীবনের অর্থ যেন শুধুই মৃত্যুর প্রতীক্ষায়, যেখানে
মানবতা এক বিস্মৃত শব্দ মাত্র।
No comments:
Post a Comment